সনেটের বৈশিষ্ট্য
   “সনেট”
শব্দটি ইটালিয়ান “সনেটো” শব্দ থেকে এসেছে,যার অর্থ মৃদু ধ্বনি । সনেট এক প্রকার মন্ময়
কবিতা । কবির একটি মাত্র ভাব কল্পনা ১৪ টি লাইনে একটি বিশেষ মিল রীতির মধ্য দিয়ে আটোসাটো
বাঁধনে আত্মপ্রকাশ করে ।  
      
ইটালিয়ান কবি পিয়ারো  ভিন সর্বপ্রথম
সনেটের প্রবর্তন করেন । সিসিলীয় কবি গুইত্তোন সর্বপ্রথম সনেটের নিয়ম কানুনের বাঁধনটি
দেখান । ত্রয়োদশ শতকে ইটালিয়ান কবি পিয়ারো ভিনের রচনায় প্রথম সার্থক সনেটের ব্যবহার
দেখা । কিন্তু সনেট বলতে আমরা যা বুঝি তার যথার্থ জনক হলেন ইতালীয় কবি পেত্রার্ক ।
 ইংরেজি সাহিত্যে সিডনি,শেক্সপিয়ার,মিলটন ,ওয়ার্ডসওয়ার্থ,কীটস
যেমন সুবিখ্যাত সনেট রচয়িতা তেমনি বাংলায় দেবেন্দ্রনাথ সেন ,মোহিতলাল মজুমদার,প্রমথ
চৌধুরি,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিশিষ্ট সনেট রচয়িতা । তবে মাইকেল মধুসূদনের হাতেই
বাংলা সনেটের নান্দীমুখ ঘোষিত হয় । 
সনেটের বৈশিষ্ট্যঃ-
      
১। পেত্রার্কীয় সনেটের অষ্টক ও ষটকের বিভাজন খেয়াল খুশি মতো নয়,তা সাগর  
          
তরঙ্গের মতো অষ্টকে স্ফিত এবং ষটকে প্রসমিত রূপ দেখা যায় । 
       
২। সনেটে ১৪ টি চরণে একটি ভাবের নিটোল রূপ দেখা যায় এবং এখানে পরিমিত কথায়    
           
ভাবের প্রকাশ ঘটে ।
        
৩। সনেটের মধ্যে কবি মনের উদ্দামতার কোনো স্থান নেই ,তা অত্যন্ত সংহত ,সংযত
            
স্থাপত্যধর্মী ।
         
৪। সনেটের মাত্রা নির্ণয়রীতি অক্ষরবৃত্তের মতো। অক্ষরবৃত্তের মতো এখানে তান
ও 
            
ভাবের গাম্ভীর্য থাকে ।
          
৫। সনেটে যেমন ভাবের গভীরতা থাকে তেমনি থাকে ওজন সমৃদ্ধ শব্দের ব্যবহার । 
             
এই সমস্ত শব্দের ব্যবহার পাঠকের কাছে অনেক সময় দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে । এই    
             
প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরি বলেছেন – “শিল্পী যাহে মুক্তি লভে অপরে ক্রন্দন ।”
          
৬। একটি বিশেষ মিল রীতি মেনে চলার জন্য সনেটের সতঃস্ফুর্ততা অন্যান্য 
               গীতিকবিতার থেকে কম । 
          
৭। সনেটের আয়তন খুব বড় হবে না । চৌদ্দ চরণের মধ্যে কবিকে ভাব ও বিষয় প্রকাশ
  
               করতে হয় ।
            
৮। পেত্রার্কীয় সনেটের অষ্টকে থাকে মূলভাব,ষটকে থাকে তার ব্যাখ্যা । শেক্সপিরীয়
                 সনেটে এই ধরণের কোনো নির্দিষ্ট নেই
।
            
৯। সনেটের মিল হতে হবে নিখুঁত । 
            
১০। সনেটে একটি মাত্র ভাবের দ্যোতনা থাকে ।
            
১১ । এর ভাবে গভীরতা ও ভাষায় ঋজুতা থাকবে । 
            
১২। সনেট সাধারণত চতুর্দশ অক্ষর সমন্বিত চৌদ্দ পংক্তির কবিতা ।
সনেটের শ্রেণি বিভাগ –
  আধুনিক
সনেট তিন ধরণের । (১) পেত্রার্কীয়  (২) শেক্সপিরীয়  (৩)ফরাসি 
১) পেত্রার্কীয় রীতি – ইতালিয় সনেট পেত্রার্কের
নাম অনুসারে পেত্রার্কীয় সনেট নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই রীতির সনেট অষ্টক ও ষটক এই
দুই ভাগে বিভক্ত । সনেটের প্রথম আটটি পংক্তি অষ্টক এবং শেষের ছয়টি পংক্তি ষটক । অষ্টকে
মূলভাবের বা বিষয়ের উল্লেখ থাকে এবং ষটকে তার ব্যাখ্যা বা উপসং হার থাকে । অষ্টক আবার
চার পঙক্তি নিয়ে দুটি চতুষ্কে বিভক্ত । এই রীতির ছন্দের মিল বিন্যাস হল – কখ খক , কখ
খক এবং ষটকের মিলের পদ্ধতি হল চছ চছ চছ  অথবা
চছজ চছজ ।
২) শেক্সপিরীয় রীতি – শেক্সপীয়র ইতালিয় পদ্ধতি
গ্রহণ না করে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিনব মিল বিন্যাস রীতিতে সনেট রচনা করেন । তিনি তিনটি
চতুষ্ক এবং একটি দ্বিপাদিকা নিয়ে সনেট রচনা করেন । তার মিল বিন্যাস হল- কখ কখ ,গঘ গঘ,
ঙচ ঙচ , এবং ছছ । দ্বিপাদিকাটি সমিল হয় ।
৩) ফরাসি রীতি – এই রীতির সনেট খুব লেখা হয়নি  । এই সনেট সাধারণত আয়রণ ও স্যাটায়ার প্রকাশের জন্য
ব্যবহৃত হয়েছে । দ্যুবেল এই রীতিতে সনেট রচনা করেছেন । এর মিল বিন্যাসের রীতি হল –
কখ কখ ,কখ কখ , গগ , চছ,চছ । 
তথ্যঋণ – 
     ক)
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
     খ)
সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় 
     গ)
বাংলা সাহিত্যের নানা রূপ- শুদ্ধসত্ত্ব বসু
     ঘ) সাহিত্যের রূপরীতি ও তত্ত্ব- তপন চট্টোপাধায়
     ঙ)
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি- উজ্জ্বল কুমার মজুমদার 
