বাংলা ভাষায় সর্বনাম পদের খুব ঘটা। নানাশ্রেণীর সর্বনাম,যথা ব্যাক্তিবাচক, স্থানবাচক, পরিমাণবাচক, তুলনাবাচক, প্রশ্নবাচক। - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সর্বনাম বলতে আমরা কী বুঝি-
একই পদের বার বার ব্যবহার যেমন আমাদের বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে ,তেমনি ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করে । ভাষার মাধুর্য রক্ষার জন্য তাই একই পদের
বারবার ব্যবহার কখনোই কাম্য নয় । ভাষার এই সমস্যা দূর করার জন্য বিশেষ্য পদের পরিবর্তে যে অন্যপদ ব্যবহার করা হয় তাকে সর্বনাম বলে। সর্বনাম কথাটির অর্থ হল 'সকল নাম'। তাই আমরা বলতে
পারি বিশেষ্য পদের পরিবর্তে যে পদ ব্যবহার করা হয়, তাকে সর্বনাম পদ বলে। সব রকম নামের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় বলে এর নাম সর্বনাম
।
সর্ব অর্থাৎ সর্বপ্রকার নামের স্থলে হয় বলিয়া ‘সর্বনাম’ এই নামকরণ হইয়াছে - সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়
আচার্য সুনীতি
কুমার চট্টোপাধ্যায় সর্বনামকে ‘প্রতিনাম’ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন । তাঁর মতে সর্বনামের
উদ্দেশ্য এই পদের দ্বারা সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয় ।
১) ব্যক্তিবাচক সর্বনাম বা পুরুষবাচক সর্বনাম :
ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক শব্দের পরিবর্তে যে সর্বনাম ব্যবহৃত হয়, তাকে ব্যক্তিবাচক সর্বনাম বলে। একে পুরুষবাচক সর্বনামও বলে।
পুরুষবাচক সর্বনাম তিন ধরণের হয়- (ক) প্রথম পুরুষের সর্বনাম বা ভিন্ন পক্ষের সর্বনাম
(খ) মধ্যম পুরুষের সর্বনাম বা শ্রোতা পক্ষের সর্বনাম (গ) উত্তম পুরুষের সর্বনাম বা
বক্তা পক্ষের সর্বনাম ।
উদাহরণ : আমি, তুমি, আমরা, তোমরা, সে , তারা ইত্যাদি।
বাক্যে প্রয়োগ
– তুমি কোন কাননের ফুল । বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি ।
২) নির্দেশক সর্বনাম :
যে সর্বনাম কোনো ব্যক্তি, বস্তু ইত্যাদি নির্দেশ করে, তাদের নির্দেশক সর্বনাম বলে।
উদাহরণ : এ,এই, ও,ওই , ইহা , উহা ,তা,তাহা,ইনি,উনি ইত্যাদি
বাক্যে প্রয়োগ: উনি আজ আসবেন।
, ইহা বর্তমান কালের ফ্যাসন হইয়াছে ।
নির্দেশক সর্বনাম দুই প্রকার- (ক) সামীপ্যবাচক নির্দেশক সর্বনাম বা নৈকট্যসূচক নির্দেশক
সর্বনাম ও (খ) দূরত্ত্ববাচক নির্দেশক সর্বনাম ।
যে সর্বনাম
কাছের বা নিকটের কোনো ব্যাক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করে তাদের সামীপ্যসূচক বা নৈকট্যসূচক
নির্দেশক সর্বনাম বলে । যেমন: এ,এই,ইহা,ইনি,এরা ইত্যাদি।
যে সর্বনাম
দূরের কোনো ব্যাক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করে তাদের দূরত্ত্ববাচক নির্দেশক সর্বনাম বলে
। যেমন: ও,ঐ,উনি,ওরা,উহা ইত্যাদি।
৩) অনির্দেশক সর্বনাম :
যে সর্বনাম কোনো ব্যক্তি,বস্তু,বা ভাবকে নির্দিষ্ট
করে বোঝায় না , তাদের অনির্দেশক সর্বনাম বলে।
উদাহরণ : কেউ,কেহ,কেউ কেউ,কিছু,কিছু
কিছু ,কোথাও ইত্যাদি ।
বাক্যে প্রয়োগ-
কেউ কেউ এ কথা জানে । কিছু কিছু ভুল হয়েছে ।
৪) প্রশ্নবাচক সর্বনাম :
যে সর্বনাম
দ্বারা কোনো কিছু জানতে চাওয়া হয় বা প্রশ্ন করা হয় ,তাকে প্রশ্নবাচক সর্বনাম পদ বলে
।
উদাহরণ : কে,কী,কি,কোন,কারা, ইত্যাদি
।
বাক্যে প্রয়োগ
– কে আজ আসবে ? তুমি কী খেয়েছো ?
৫) আত্মবাচক সর্বনাম :
‘অন্য কারো
সাহায্য ছাড়া’ এই ভাবটি বোঝাবার জন্য বিশেষ্য ও সর্বনামের সঙ্গে যে সর্বনাম ব্যবহৃত
হয় তাকে আত্মবাচক সর্বনাম বলে । এই সর্বনাম নিজস্ব বা আত্মভাব প্রকাশ করে ।
উদাহরণ : স্বয়ং , নিজে , নিজ , খোদ , নিজে-নিজে , আপনি,আপনারে ইত্যাদি।
বাক্যে প্রয়োগ
– তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন । আপনি নিজে কাজটি করেছেন ।
৬) সাপেক্ষ সর্বনাম বা নিত্যমম্বন্ধী সর্বনাম :
যে সর্বনাম
পদ দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা বস্তুর সংযোগ সাধন করে বা সঙ্গতি বিধান করে তাকে সাপেক্ষ
সর্বনাম বলে । এই সর্বনামগুলি নিত্য সম্বন্ধযুক্ত থাকে ,অর্থাৎ একটি ব্যবহার করলে আর
একটি ব্যবহার করতেই হয় । এই সর্বনামকে সঙ্গতিবাচক বা সংযোগবাচক সর্বনামও বলে । এই সর্বনামকে
সমুচ্চয়ী সর্বনামও বলে ।
উদাহরণ : যে-সে,যিনি-তিনি,যাহা-তাহা,যা-তা,যাকে-তাকে
বাক্যে প্রয়োগ
– সে সহে সে রহে । যত মত তত পথ ।
৭) সমষ্টিবাচক সর্বনাম বা সাকল্যবাচক সর্বনাম :
যে সর্বনামের দ্বারা সমষ্টিবাচক ব্যক্তি,বস্তু বা ভাবকে বোঝানো হয়, তাকে সমষ্টিবাচক সর্বনাম বা সাকল্যবাচক সর্বনাম বলে।
উদাহরণ : সব,সর্ব,সকল,সবাই,সবার,সবে
ইত্যাদি ।
বাক্যে প্রয়োগ – সকলের তরে সকলে আমরা ।
৮) ব্যতিহারিক বা পারস্পরিক সর্বনাম -
যে সর্বনামের দ্বারা পারস্পরিক সম্বন্ধ বোঝানো হয়, তাকে পারস্পরিক বা ব্যতিহারিক সর্বনাম বলে।
এই সর্বনামে
‘অন্যের প্ররোচনা বা সাহায্য ব্যতীত’ এই রকম অর্থ প্রকাশিত হয় ।
উদাহরণ : নিজে-নিজে , আপনা-আপনি
বাক্যে প্রয়োগ
– নিজে নিজে কাজটি করো । আপনা আপনি জেগে উঠল ।
৯) অন্যাদিবাচক সর্বনাম -
যে সর্বনাম
উদ্দিষ্টভিন্ন অন্য কোনো ব্যক্তি ,বস্তু বা ভাবকে নির্দেশ করে তাকে অন্যাদিবাচক সর্বনাম
বলে ।
উদাহরণ : অন্য,অপর,অমুক ইত্যাদি
।
বাক্যে প্রয়োগ
– তুমি নও অন্য কেউ কাজটি করেছে ।
১০) যৌগিক সর্বনাম
দুটি সর্বনাম
পদ যুগ্মভাবে একটি সর্বনাম হিসাবে ব্যবহৃত হলে তাকে যৌগিক সর্বনাম বলে ।
এই সর্বনাম
আসলে অনির্দেশক সর্বনাম হিসেবেই পরিচিত ।
যেমন: যে কেউ, কে একটা, যা কিছু ইত্যাদি।
কখনো কখনো সর্বনাম পদের পরপর দুবার প্রয়োগ হয়,তাকে আমরা সর্বনামের দ্বিত্ব বলি ।
যেমন: কেউ কেউ এ রকম মনে করে । যে যে
যাবে এসো ।
কিন্তু সর্বনামের দ্বিত্ব এবং যৌগিক সর্বনাম এক
বিষয় নয় ।