HEADER ADDS

সাত ভাই চম্পা - বিষ্ণু দে

‘সাত ভাই চম্পা’ কবিতাটি আধুনিক যুগের অন্যতম শক্তিশালী কবি বিষ্ণু দের ‘সাত ভাই চম্পা’ (১৯৪৫) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে । পরাধীন দেশের স্বাধীনতা কামনা ও সাম্যবাদী ভাবনা,শোষণমুক্তির কামনা ‘সাত ভাই চম্পা’ কবিতায় একাত্ম হয়ে উঠেছে । রূপকথার সাত ভাই চাঁপা হয়ে ফুটেছিল । কবি সেই রাজকুমারদের আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের ছেলেরদলে । দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে তারা আত্মবলিদানে উন্মুখ । নিবেদিত প্রাণ এই সমস্ত ছেলেরা সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করে । চম্পা আমাদের মধ্যেই আছে । আমাদের মধ্যেই আছে মুক্তির সম্ভাবনা ,কিন্তু চাপা পড়ে আছে । সকলের কাঙ্ক্ষিত সেই মুক্তির জন্য পারুল রাঙানো রাজকুমারেরা সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করতে প্রস্তুত । তাই কবি বলেছেন 

কত  সমুদ্র কত নদী হয় পার!

বিরাট বাংলা দেশের কত-না ছেলে

অবহেলে সয় সকল যন্ত্রণাই -        

                                সাত ভাই চম্পা-  বিষ্ণু দে

  বিপর্যস্ত মানুষ মুক্তির সন্ধানে ঘুরছে । শ্রমজীবি মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের চিত্র ফুটে উঠেছে এই কবিতায় । পরাধীন দেশের স্বাধীনতা কামনা ও শোষণমুক্তির কামনা এই কবিতায় এক জায়গায় এসে দাড়িয়েছে। কবি গণজাগরনের কথা বলেছেন । মার্কসবাদী ভাবনায় অনুপ্রাণিত কবি গণ জাগরণের স্বপ্ন দেখেছেন । তিনি মনে করতেন জীবন সমস্যা শুধু কবির ব্যক্তিত্ব সংশ্লিষ্ট নয় । পরাধীন দেশের জনগণ  বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন  জায়গায় চম্পার খোঁজে ব্যস্ত । রাজা থেকে কৃষক ,অশ্বের খুর থেকে লাঙলের ফলা, হাতুড়ির ঘা,কাস্তের বাঁকা শানে ভাটিয়ালি গানে,কপিলমুনির দ্বীপে সর্বত্র , সর্বস্তরের মানুষ চম্পার খোঁজে ব্যস্ত । কারণ চম্পার প্রেমে বাংলা দেশ কত শাওন রজনী কাটিয়েছে । আজ সেই চম্পা অধরা । আর তাই কবি বলেছেন –

   
তোমাকে খুঁজেছে জানো কি কৃষকে নৃপে

অশ্বের খুরে,লাঙলের ফলা টেনে,

হাতুড়ির ঘায়ে , কাস্তের বাঁকা শানে ,

ভাটিয়ালি গানে,কপিলমুনির দ্বীপে;

কলিঙ্গে আর কঙ্কণে গুর্জরে

চম্পা,তোমার সাত ভাই গান করে।  –

                                                   সাত ভাই চম্পা-  বিষ্ণু দে

  শ্যামদেশ,কম্বোজে ( থাইল্যান্ড,কম্বোডিয়া) চম্পার সাত ভাই দাঁড় টানে বলে কবি সংশয় প্রকাশ করেছেন  । বাংলায় নতূন বুর্জোয়া শক্তির উত্থানকে চিহ্নিত করার জন্য কবি চাঁদ সদাগর ও শ্রীমন্ত সদাগরের প্রসঙ্গ এনেছেন । অকুতোভয় ছেলেদের আত্মবলিদানের মাধ্যম্যে যবদ্বীপে সাড়া আসে, বলী হাসে । এরাই নীলকমলের দেশে হাড় রেখে আসে । ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে , আত্মীয়-পরিজনদের স্নেহ,ভালোবাসা ভুলে এরা বাহিরকে ঘর করে, আপনকে পর করে । কোনো পিছুটান থাকে না । দেশের ও দশের সেবায় উৎসর্গীকৃত । 

  সমকালের সাময়িক বিপর্যয়ে জনগণ নিস্তেজ , অবরুদ্ধ । জনগণকে বিপ্লবী চেতনায় জাগিয়ে তুলতে দরকার চম্পার মতো এক নেতৃত্বের । স্বাধীনতা আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে সঙ্কট ও দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজেছেন কবি । চম্পার প্রাণ অবিনশ্বর, চম্পা মৃত্যু অতিক্রমী । কিন্তু কোন এক হিরণ্মায়ায় তা ঢাকা পড়ে আছে । আজ তার প্রকাশ জাতির কাছে, দেশের কাজে , নীপিড়িত জনগণের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । তাই কবি বলেছেন –

চম্পা, তোমার অবিনশ্বর প্রাণ

এ কোন হিরণ্মায়ায় রেখেছ ঢেকে,

খুলে দাও মুখ,রৌদ্রে জ্বলুক গান ।                                সাত ভাই চম্পা-  বিষ্ণু দে

 

 

পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় , ধনতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে । একদিকে পরাধীনতার গোলামী , অন্যদিকে অর্থনৈতিক  শোষণ সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত জর্জরিত করছে । এর থেকে সকলেই মুক্তি চায় । কিন্তু সেই মুক্তির সন্ধান জানে না কেউ । মুক্তির দিশা খুঁজে পায় না কেউ । তার হদিশ দিতে পারে না কেউ । তবু তাকে সারা দেশ খুঁজে মরে। কারণ তাই পরম কাঙ্খিত,পরম শ্রেয় ,বাঁচার আশ্বাস । তাই কবির একান্ত কামনা-

 
 ঘোচাও চম্পা,দুস্থ ছদ্মবেশ,

এ মাহ ভাদরে ভরা বাদরের শেষে

চকিতে দেখাও জনগণমনে মুখ –                                                সাত ভাই চম্পা-  বিষ্ণু দে

 

ভিডিও ক্লাসের জন্য এখানে ক্লিক করুন

আমরা দেখেছি রুপকথায় পারুল রাঙানো রাজকুমারদের , কিন্তু বাস্তবে তাদের বেশ দঃস্থ ।কিন্তু সেই দুঃস্থ ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে জনগণের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করার কথা বলেছেন কবি । বিদ্যাপতির ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূণ্য মন্দির মোর’ পদটির প্রসঙ্গ এনে দেশের জনগণের অধীর প্রতীক্ষাকে যেমন কবি ব্যঞ্জিত করলেন , তেমনি রাধার অন্তর্বেদনার সঙ্গে দেশবাসীর অন্তর্বেদনাকে মিলিয়ে দিলেন । সেই পরম কাঙ্ক্ষিত মুক্তি সুখ ,যা একান্তই কাম্য –

     
 মুক্তি!মুক্তি! চিনি সে তীব্র সুখ ,

সাত ভাই জাগে, নন্দিত দেশ দেশ ।।                                                সাত ভাই চম্পা-  বিষ্ণু দে