HEADER ADDS

শব্দভাণ্ডার

শরীরতত্ত্ববিৎ যেমন অণুবীক্ষণ যোগে প্রত্যেক কোষকে পরীক্ষা করেন,সেই রূপ যুক্তির অণুবীক্ষণ যোগে প্রত্যেক শব্দকে পরীক্ষা করিতে হইবে । কোনো শব্দকে অবহেলা করা চলিবে না । -রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (শব্দকথা)

           ভাষা ভাবের বাহন । ভাষার প্রধান উপাদান হল শব্দ। ভাষার শব্দশক্তির উপর ভাষার সমৃদ্ধি নির্ভর করে । যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যত বেশি উন্নত,সেই ভাষা তত উন্নত। ভাষার প্রকাশ ক্ষমতা নির্ভর করে শব্দ সম্পদের উপর। বাংলা পৃথিবীর উন্নত ভাষাগুলির অন্যতম । তিনটি উপায়ে বাংলা ভাষা তার শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ।

·      উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া শব্দের সাহায্যে

·      অন্য ভাষা থেকে গৃহীত শব্দঋণের সাহায্যে

·      নতূন শব্দ সৃষ্টির সাহায্যে

   প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে এক বিশেষস্তরে এসে নব্যভারতীয় আর্যভাষার অন্যতম বাংলা বাংলা ভাষার উদ্ভব হয় । ফলে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার ( বৈদিক সংস্কৃত ) অনেক শব্দ কখনো সরাসরি ,কখনো কিছুটা পরিবর্তিত আবার কখনো বা কিছুটা বিকৃত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে । বিভিন্ন অনার্য গোষ্ঠীর ভাষা যেমন বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে ,তেমনি অন্যান্য বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার শব্দও বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে স্থান পেয়েছে । পারস্পরিক আদান-প্রদানের মধ্যমে যেমন বিভিন্ন দেশিয় ভাষার শব্দ এসেছে তেমনি বিভিন্ন বিদেশি শব্দ এসেছে। তাই বাংলা শব্দভাণ্ডারের শব্দগুলিকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি –

(ক) মৌলিক শব্দ বা নিজস্ব নিজস্ব  (খ) আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ   (গ) নবগঠিত শব্দ

 

Ø মৌলিক শব্দ- প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা (বৈদিক সংস্কৃত) থেকে আগত শব্দগুলিকে মৌলিক শব্দবলে। মৌলিক শব্দ তিন প্রকার – (১) তৎসম শব্দ   (২) অর্ধতৎসম শব্দ  (৩) তদ্ভব শব্দ 

 (১) তৎসম শব্দ – ‘তৎসম’  একটি সমাসবদ্ধ শব্দ । তৎ = তার , সম= সমান অর্থাৎ সংস্কৃতের সমান ।

  যে সমস্ত শব্দ সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে অপরিবর্তিত ও অবিকৃতভাবে বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের তৎসম শব্দ বলে ।

যেমন- আকাশ,নদী,লতা,সূর্য,চন্দ্র,নক্ষত্র,বৃক্ষ,কৃষ্ণ,মুনি,অন্ন,রাত্রি,মিত্র,বিদ্বান,হস্তী,অশ্ব,পন্ডিত,সুন্দর,শিক্ষক ইত্যাদি .বাংলায় প্রচলিত তৎসম শব্দের সংখ্যা অনেক । প্রায় সব ভাষাতাত্বিক একমত বাংলা ভাষায় প্রচলিত ৪৫ শতাংশ শব্দই তৎসম শব্দ ।

তৎসম শব্দ আবার দুভাগে বিভক্ত- সিদ্ধ তৎসম ও অসিদ্ধ তৎসম । যে সব কেবল বৈদিক ও সংস্কৃত সাহিত্যে মেলে এবং যা ব্যাকরণসম্মত,সে গুলি সিদ্ধ তৎসম । যেমন- ভূমি, মুনি,সূর্য,চন্দ্র,কৃষ্ণ,নর ইত্যাদি । যে সমস্ত শব্দ প্রাচীনকালে শুধুমাত্র মৌখিক সংস্কৃতে বা কথ্য সংস্কৃতে পাওয়া যায়,ব্যাকরণসিদ্ধ হয়নি তা অসিদ্ধ তৎসম । যেমন- ঘর,চল,কৃষাণ ইত্যাদি ।

তৎসম শব্দ চেনার কৌশল জানতে এখানে ক্লিক করুন


(২) অর্ধ তৎসম  বা ভগ্ন তৎসম শব্দ -  যে সমস্ত শব্দ সংস্কৃত থেকে আসার সময় প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে না এসে সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে এবং কিছুটা বিকৃতি লাভ করেছে তাদের অর্ধ তৎসম শব্দ বলে । আসলে এই সমস্ত শব্দগুলি বিকৃত তৎসম শব্দ । এদের ভগ্ন তৎসম শব্দও বলে । যেমন- বৈষ্ণব>বোষ্টম , শ্রী> ছিরি , গৃহিণী>গিন্নি ,নিমন্ত্রণ>নেমন্তন্ন,শ্রাদ্ধ>ছেরাদ্দ,জ্যোৎস্না>জোছনা,পুরোহিত>পুরুত,প্রণাম>পেন্নাম,কৃষ্ণ>কেষ্ট ইত্যাদি । অর্ধ তৎসম শব্দের ব্যবহার চলিত ও মৌখিক ভাষায় ।



(৩) তদ্ভব শব্দ -  তৎ = তার, ভব=জাত বা উৎপন্ন অর্থাৎ তার (সংস্কৃত ) থেকে জাত বা উৎপন্ন ।  যে সমস্ত শব্দ সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের মাধ্যমে নিয়মানুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের তদ্ভব শব্দ বলে । তদ্ভব শব্দকে প্রাকৃতজ শব্দও বলে । বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের অধিকাংশ শব্দই প্রাকৃতে পাওয়া যায় । তদ্ভব শব্দগুলিই বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ ।  যেমন- কৃষ্ণ>কণ্‌হ্‌>কানু , ধর্ম>ধম্ম>ধাম , সন্ধ্যা>সন্‌ঝা>সাঁঝ,কার্য>কজ্জ>কাজ ,হস্ত>হত্থ>হাত ইত্যাদি ।

 

Ø আগন্তুক শব্দ বা কৃতঋণ শব্দ – সাংস্কৃতিক,রাষ্ট্রিক,বাণিজ্যিক,ঔপনিবেশিক বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন জাতি ও ভাষার সাথে বাঙালির সংস্পর্শ ঘটেছে । ফলে পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে সেই সমস্ত ভাষার শব্দসমূহ বাংলা ভাষায় এসেছে । এই সমস্ত শব্দকে আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ বলে । এককথায় অন্য ভাষা থেকে আগত শব্দগুলিকে কৃতঋণ শব্দ বলে । কৃতঋণ শব্দগুলিকে আমরা দেশি ,প্রাদেশিক ও বিদেশি এই তিন ভাগে ভাগ করতে পারি ।

১) দেশি শব্দ- আর্য জাতির আগমনের পূর্বেই ভারতের অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ ভারতে এসেছিল । এদের মধ্যে দ্রাবিড়,অস্ট্রিক বা নিষাদ গোষ্ঠীর ভাষা থেকে আগত শব্দগুলিকে দেশি শব্দ বলে । এককথায় বিভিন্ন অনার্য জাতির ভাষা থেকে আগত শব্দ গুলিই দেশি শব্দ । যেমন- ঝাঁটা ,ঝুড়ি, কুলা,ডাগর,মুড়ি ,চিংড়ি,খোকা,ডিম,ডাহা, পাঁঠা , তেঁতুল, ইত্যাদি ।

 দেশি শব্দ সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন

২) প্রাদেশিক শব্দ – বাংলার বিভিন্ন প্রতিবেশী রাজ্যের ভাষা থেকে বিভিন্ন প্রাদেশিক শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে । এদের প্রাদেশিক শব্দ বলে ।

·      হিন্দি – খানা,পানি,ঠিকানা,মিঠাই,ফালতু,ঝান্ডা,দোসরা, ভেঁপু ইত্যাদি ।

·      গুজরাটি – হরতাল,খাদি,গর্বা,তকলি ইত্যাদি ।

·      মারাঠি – চৌথ,বর্গী ,পেশোয়া,পাতিল ইত্যাদি ।

·      পাঞ্জাবি – শিখ,চাহিদা  ইত্যাদি ।

·      তামিল – মলয়,ঘোড়া,খুকি,চুরুট, ভিটা ইত্যাদি ।

(৩) বিদেশি শব্দ –বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিদেশির জাতির আগমন ঘটেছে । সেই সমস্ত জাতির ভাষা থেকে বিভিন্ন শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে,এই শব্দগুলিকে বিদেশি শব্দ বলে । যেমন-

 

·      আরবি- নামাজ,ইমাম,কোরান,মৌলবি,আদায়,আজব,আইন,আমানত,কায়দা,দলিল,নবাব,মুনাফা

·      ফারসি – আমির,উকিল,গজল,গোলাপ,নালিশ,মজুর,সিপাই ,মালিক,হাজার,মেথর,কামাই ইত্যাদি ।

·      তুর্কি – চাকু,চিঠি,বোচকা,কাঞ্চি,বিবি , কুলি,বাবুর্চি,বেগম ইত্যাদি ।

·      ফরাসি – কার্তুজ,কুপন,রেস্তোরা,কাফে,বুর্জোয়া, আঁতাত, রেনেসাঁ , মেনু ইত্যাদি ।

·      পর্তুগীজ – আলকাতরা, আলমারি , আনারস , আলপিন ,আচার, পাউরুটি ইত্যাদি

·      চিনা – চা,চিনি,চামচ,লিচু,লুচি ইত্যাদি ।

·      বর্মী – লুঙ্গি , ঘুগনি ইত্যাদি ।

·      ওলন্দাজ- ইস্কাবন,তুরুপ,হরতন,রুইতন,ইস্ক্রুপ ইত্যাদি ।

·      জাপানি – রিক্‌শা,হাসনুহানা,টাইফুন ,হারিকেন ইত্যাদি ।

·      রাশিয়ান – স্পুটনিক,বলশেভিক,ভদকা ইত্যাদি ।

·      ইংরেজি – প্রচুর ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে । স্কুল , চেয়ার, টেবিল , বেঞ্চ,সিনেমা ।

এছাড়াও আরও বহু বিদেশি ভাষার শব্দ বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারের সম্পদ হয়ে উঠেছে ।

 

Ø নবগঠিত শব্দএক শ্রেণির শব্দের সঙ্গে আর এক শ্রেণির শব্দ,প্রত্যয়,উপসর্গের মিশ্রণে যে নতূন শব্দ সৃষ্টি হয়,তাকে নবগঠিত শব্দ বলে । এই শ্রেণির শব্দকে মিশ্রশব্দ বা সংকর শব্দও বলে ।  যেমন-

·      তৎসম+বাংলা – পিতাঠাকুর, শ্বেতপাথর,মায়াকান্না,কাজকর্ম ।

·      তৎসম + বিদেশি – হেড পন্ডিত , নৌবহর , পর্দাপ্রথা কাগজপত্র ।

·      বিদেশি+বিদেশি – উকিল-ব্যারিস্টার,টাইম-টেবিল,হেড-মাস্টার,মেমসাহেব ।

·      তৎসম + বাংলা প্রত্যয় – ভাবুক,দেশি, লক্ষ্মী , বারমেসে ।

·      তৎসম + বিদেশি প্রত্যয় – দাতাগিরি , ধূপদানি , প্রমাণসই ।

·      বিদেশি শব্দ + তৎসম প্রত্যয় – খ্রীস্টীয় , হিন্দুত্ব ।

·      বিদেশি শব্দ + বাংলা প্রত্যয় – গোলাপী, মাস্টারি , মোগলাই ,শহুরে ।

·      বিদেশি শব্দ + বিদেশি প্রত্যয় – ডাক্তারখানা,সমঝদার,সরাইখানা ।

Ø অনূদিত শব্দ – কিছু বিদেশি শব্দ কৃতঋণ শব্দ হিসাবে সরাসরি বাংলা ভাষায় না এসে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় এসেছে , তাদের অনূদিত শব্দ বলে । যেমন- বাতিঘর (Light house), নলজাতক(Test tube baby), উড়ালপুল (Flyover) , স্বর্ণযুগ (Golden Age) ।