HEADER ADDS

শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা কত প্রকার ? প্রতিটি ধারা আলোচনা কর ।

       ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে দুটি দিক পাওয়া যায় । একটি তার বাইরের প্রকাশরূপ  আর একটি তার ভিতরের ভাব বা অর্থ । এই ভাব বা অর্থ হল ভাষার প্রাণ । এই ভাব বা অর্থকে বাদ দিলে ভাষার কোনো উপযোগিতা থাকে না । ভাষার অর্থ তিন প্রকার – লক্ষণার্থ , বাচ্যার্থ ও ব্যঙ্গার্থ । বাচ্যার্থ,ব্যঙ্গার্থ ও লক্ষণার কারণে শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে । ভাষায় দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে শব্দে জীর্ণতা দেখা যায় । আবার বিভিন্ন বাইরের কারণে ভাষার শরীরে পরিবর্তন ঘটে,ফলে সেই পরিবর্তন শব্দের শরীরেও প্রভাব ফেলে । দীর্ঘদিন ধরে চলে আশা অর্থ ক্রমে পরিবর্তিত হয় । বদলে যায় তার প্রয়োগ,বদলে যায় ব্যবহার। শব্দার্থ পরিবর্তন বিভিন্ন উপায়ে ঘটে থাকে । শব্দার্থ পরিবর্তনের এই উপায়গুলিকে তিনটি ধারায় বিভক্ত করা হয় । এই ধারা গুলি হল –

  ) অর্থের বিস্তার বা প্রসার

  ২) অর্থের সংকোচ

  ৩) অর্থ সংশ্লেষ বা অর্থ সংক্রম বা অর্থের রূপান্তর

এছাড়াও আরও দুটি ধারার কথা অনেকে বলে থাকেন । সেই ধারা দুটি হল –

   ক) অর্থের উন্নতি বা অর্থের উৎকর্ষ

   খ) অর্থের অবনতি বা অর্থের অপকর্ষ

 

শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারাগুলি আলোচনা করা হল-

১) অর্থের বিস্তার বা প্রসার –

 শব্দের মূল অর্থ যখন কোনো কারণে বস্তুর সীমাবদ্ধতা ত্যাগ করে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয় তখন সেই পরিবর্তনকে অর্থ বিস্তার বা অর্থের প্রসার বলে ।

যেমন- কালি শব্দটির দ্বারা আগে কালো রঙের তরল পদার্থকে বোঝাতো,এখন এর দ্বারা নীল,লাল,সবুজ  যেকোনো রঙের তরলকে বোঝায় । আবার জুতো পালিশ করার কালি তরল না হলেও তাকে কালি বলা হয় এবং যে কোনো রঙের পালিশকেই ।

তেল বলতে আগে তিলের নির্যাসকে বোঝাতো,কিন্তু বর্তমানে বাদাম,তিসি,নারিকেল,সরষে যে কোনো শষ্যদানার নির্যাসকেই আমরা তেল বলে থাকি । শুধু তাই নয় খনিজাত পেট্রোল,ডিজেল,কেরোসিনকেও আমারা তেল বলি ।

 এই ধরণের আরও কিছু উদাহরণ –

শব্দ

আদি অর্থ

প্রচলিত অর্থ

ছন্নছাড়া

ছন্দহীন

এলোমেলো

নগর

পর্বতের উপরের জনস্থান

শহর

বর্ষ

বর্ষাকাল

বছর

শ্বাপদ

কুকুরের মতো পা

হিংস্র

অভিযান

যুদ্ধযাত্রা

দুঃসাহসিক ভ্রমণ

অবাক

বাক্যহীন

বিস্মিত

আঁচ

উত্তাপ

অনুমান

কূপমন্ডুক

কুয়োর ব্যাঙ

সংকীর্ণ মনোভাব

কৌতুক

উৎসব

প্রমোদ

 

 👉👉👉👉 আরও পড়ুন 

২) অর্থের সংকোচন –

 কোনো শব্দ যখন কোনো কারণে ব্যাপক অর্থ হারিয়ে সংকীর্ণ বা বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয় তখন তাকে অর্থের সংকোচন বলে ।

  যেমন – অন্ন শব্দটি আগে যে কোনো খাদ্যবস্তু-কেই বোঝাত কিন্তু বর্তমানে অন্ন বলতে আমরা শুধু ভাত -কেই বুঝি ।

মৃগ বলতে আগে যে কোনো পশুকে বোঝাত । মৃগরাজ বলতে আমরা পশুদের রাজা সিংহ -কে বুঝি । কিন্তু বর্তমানে মৃগ শব্দটি সমস্ত পশুকে বোঝায় না , শুধু হরিণ- কে বোঝায় ।

শব্দ

আদি অর্থ

প্রচলিত অর্থ

অন্ন

যে কোনো খাদ্যবস্তু

ভাত

আদ্যকৃত্য

প্রথমে করণীয় কাজ

শ্রাদ্ধ

আসল

প্রকৃত

মূলধন

খুন

রক্ত

হত্যা

ঘাস

যা খাওয়া হয়

তৃণ

ছত্র

আচ্ছাদন

ছাতা

জগৎ

যা চলছে

পৃথিবী

জলদ

যে জল দান করে

মেঘ

দ্বিজ

যার দুবার জন্ম

ব্রাহ্মণ

নীড়

বাসা

পাখির বাসা

 

 

৩) অর্থ সংশ্লেষ বা অর্থ সংক্রম বা অর্থের রূপান্তর –

    শব্দের অর্থ ধাপে ধাপে পরিবর্তন হতে হতে এমন একটি পর্যায় আসে যখন তার মূল অর্থ লোপ পায় এবং মূলের সঙ্গে তার গুণ বা ক্রিয়াগত কোনো মিল তাকে না ,তখন তাকে অর্থের রূপান্তর বলে ।

যেমন সন্দেশ শব্দটির অর্থ ছিল সংবাদ। কিন্তু বর্তমানে সন্দেশ বলতে আমরা এক প্রকার মিষ্টান্ন কে বুঝি । আগে ঘর্ম কথার অর্থ ছিল গরম কিন্তু বর্তমানে আমরা ঘর্ম বলতে ঘাম বা স্বেদকে বুঝি ।

   আরও কিছু উদাহরণ -

শব্দ

আদি অর্থ

প্রচলিত অর্থ

চরকা

চাকা

সুতো কাটার যন্ত্র

কাণ্ড

গুঁড়ি 

ব্যাপার

ঘন

হত্যাকারী

মেঘ

অনটন

ভ্রমণহীন

অভাব

অন্ধকার

অন্ধ করে যে

তিমির

অবিরল

প্রচুর

অনবরত

আড়ম্বর

বাদ্যযন্ত্র বিশেষ

জাঁকজমক

আক্রোশ

ক্রোশ পর্যন্ত

রাগ

নিয়ম

সংযম

রীতি

 

 

৪) অর্থের উৎকর্ষ বা অর্থের উন্নতি -

কোনো শব্দের মূল অর্থ থেকে পরবর্তীকালে প্রতিপন্ন অর্থের দ্বারা অপেক্ষাকৃত উচ্চভাব প্রকাশ করলে তাকে অর্থের  উৎকর্ষ বা অর্থের উন্নতি বলে ।

যেমন মন্দির শব্দটির আগে অর্থ ছিল গৃহ । ( মন্দির বাহির কঠিন কপাট ।) কিন্তু বর্তমানে মন্দির কথাটির অর্থ হল দেবালয় । ( দেবতা মন্দির মাঝে ভক্ত প্রবীণ ।) আদিতে দুহিতা কথাটির অর্থ ছিল যে দোহন করে (নারী) কিন্তু বর্তমানে দুহিতা শব্দের অর্থ কন্যা ।

 

 

৪) অর্থের অপকর্ষ বা অর্থের অবনতি –

কোনো শব্দের অর্থ আগে উৎকর্ষসূচক হলেও পরবর্তীকালে তার দ্বারা হীন বা তুচ্ছ বস্তুকে বোঝালে তাকে অর্থের অপকর্ষ বা অর্থের অবনতি বলে ।

যেমন মহাজন শব্দের আদি অর্থ মহৎ যে জন কিন্তু শব্দের অর্থের অবনতির ফলে বর্তমানে এর অর্থ দাড়িয়েছে সুদখোর বা কুষিদজীবী ।  রাগ শব্দটির পূর্বে অর্থ ছিল আকর্ষণ  কিন্তু বর্তমানে রাগ শব্দটির অর্থ হল ক্রোধ ।

    

এইভাবে ভাষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের মাধ্যমে । সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের আবেগ,ভাবনা,রুচি,বদলায়। বদলায় রাজনৈতিক পরিবেশ,আর্থ সামাজিক পরিবেশ । এই পরিবর্তনের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের প্রকাশভঙ্গীর যেমন পরিবর্তন ঘটে তেমনি পরিবর্তন ঘটে জীবনাচরণেও । এই পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য ভাষাকেও পরিবর্তিত হতে হয় । ভাষা প্রবহমান নদীর মতো।