HEADER ADDS

হরিণা বৈরী - কবিতা সিংহ

                                                               হরিণা বৈরী 

                                                                               কবিতা সিংহ 


            কোনো বিশেষ ঘটনা যেমন কখনো কখনো অন্যঘটনার উপর প্রভাব বিস্তার করে, ব্যক্তি বিশেষের আচরণ অন্য ব্যক্তির উপর সঞ্চারিত হয় ,তেমনি  বিশেষ কোনো সাহিত্য অন্য একটি সাহিত্যকর্মের উপর প্রভাব বিস্তার করে । দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে সাহিত্যিকের মনোভাবনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে । রূপক-প্রতীক-অনুষঙ্গ সাহিত্যিকের বিষয় ভাবনায় নবরূপ লাভ করে । দেশ-কাল-চরিত্র  পটপরিবর্তনেও জীবন্ত থেকে যায় ।  

         

          দশম-দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সাধনসঙ্গীত হলেও রূপকে প্রতীকে সমাজবাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে  ছত্রে ছত্রে । ভুসুকু পাদের রচনা ‘কাহেরে ঘিণি এলি অচ্ছহু কীস’ পদটি তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ । পাঠসমালোচনায় এই পদটি বর্তমান সমাজভাবনায় অন্য রূপকে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কবিতা সিংহের হরিণা বৈরী কবিতাটিতে ।

 

          ভুসুকু পাদের ‘অপণা মাংসে হরিণা বৈরী’ দেশ কাল অতিক্রম করে আজও প্রাসঙ্গিক । নিজের মাংসই হরিণের সব চেয়ে বড় শত্রু । যদি আমরা চর্যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে বাদ দিয়ে আলোচনা করি , তাহলেও এই অংশুটির ভাবব্যঞ্জনা ও অর্থের গূঢ়তা কোনো অংশে কম নয় । নিজের  চরম শত্রুকে নিজের মধ্যেই পালন করে , প্রতি মূহুর্তে  এক অজানা শঙ্কায় , অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলায় নিজেকে তৈরি রাখা । 

ভিডিও ক্লাসের জন্য এখানে ক্লিক করুন 

 

          ভুসুকুর আলোচ্য পদটিতে আমরা দেখতে পাই শিকারী চারিদিকে বেড়া দিয়েছে । ব্যাধের তীরের নাগালের বাইরে পালিয়ে যাবার জন্য হরিণি হরিণকে বন ত্যাগ করে অন্যবনে পালিয়ে যাবার পথ নির্দেশ দিয়েছে । আমরা দেখেছি ক্ষিপ্র গতিতে হরিণের ছুটে চলার চিত্র ।

 

         সময় বদলেছে , সমাজ বদলেছে , বদলেছে ব্যক্তি মানুষের রুচি,মানসিকতা, কিন্তু কোথাও না কোথাও রক্তে থেকে গেছে আদিম রিপুর ছায়া । ভুসুকুর হরিণ কবিতা সিং হের কবিতায় হয়েছে হরিণি । সেই হরিণি সন্ত্রস্ত নারী । হরিণের মাংস যেমন প্রধান শত্রু , তেমনি নারীর দেহসুষমা তার প্রধান শত্রু । ফলে সমাজপথ তার কাছে নিরাপদ নয় । চারিদিকে লোলুপ দৃষ্টিতে ফাঁদ পেতে আছে আদিম রিপু । দেহকেন্দ্রিক নারীমাংসের লোভে কামনা বাসনায় লিপ্ত পুরুষ সমস্ত মানবিক গুনের জলাঞ্জলি দেয় । হরিণের মতো তার আপন মাংসই তার বৈরী । তার চলার পথ আর পথ থাকে না ,তা হয়ে ওঠে ‘আগুন নদী’, সে পথ ‘অঘোর গৈরী’ । তার পুড়ে যায় , ত্বক জ্বলে যায় । জীবনের যে বীণা বিচিত্র সুরে অনুরণিত হওয়ার কথা ছিল , তা হয়ে যায় একতারা । জীবনের শখ , স্বাদ, আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে নারী হয়ে ওঠে বৈরাগিনী ।

 

         এই নারী একা নারী । সে অসহায়, সে নিঃসঙ্গ । একাকী নারীর পথ চলা বড় দুঃসহ। তাই সে ডাকে -

কোথা রে হরিণ তুই কোথা চিন্তামণি?

                 বৈরী আপনা মাসে তোর হরিণী !

ভুসুকুর পদে হরিণকে পথ বলে দিয়েছিল তার হরিণি। একাকী নারীকে পথ বলে দেওয়ার কেউ নেই । এ লড়াই তার একার । তাকেই খুঁজে নিতে হবে তার ‘নিলয়’।

একলা নিলয় খুঁজে চলা কোনো মেয়ে কোনো কালে , কোনো দেশে পেয়েছে কি নিজস্ব নিলয় ? কোনো মেয়ের কোনো নিজস্ব ঘর আছে বা থাকে কিনা  - তা আমাদের জানা নেই । তাই নিরাশ্রয় মেয়েদের অধিকারহীনতার মর্মদাহের কথা , মেয়েদের দীর্ঘনিঃশাস পড়া আত্মকথার পাতায় উচ্চারিত হয় তাদের অসহায় অধীনতার বিবরণ।  - ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় ( বাংলা কবিতা , পর্বে পর্বান্তরে )

 

           যে সমাজ নারীর অধিকারকে মেনে নেয় না, যে সমাজ নারীর সম্মানকে গুরুত্ব দেয় না , যে সমাজ একাকী নারীকে ভোগের সামগ্রী করে রাখে ,সেই সমাজের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে নারী হয়ে ওঠে প্রতিবাদিনী । যে সমাজ নারীমনের খোঁজ রাখে না , সেই সমাজের প্রতি বর্ষিত হয় ক্রুদ্ধ নারীর অগ্নিবাণ। একাকী পথে সে হয়ে ওঠে ক্রুরগামিনী । সমস্ত কমনীয়তা,পেলবতাকে বিসর্জন দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সে হয়ে ওঠে শ্মশানবাসিনী রুদ্রাণী ।

 

             মনন-মানসিকতায়,চিন্তনে-চেতনায় সমাজ-বাস্তবতায় আধুনিক মানুষ আজ বহু দূর পথ পরিক্রমায় ব্রতী । কিন্তু মনের অন্ধকার কোনের রিপুর তাড়নাকে সে অতিক্রম করতে পারেনি । শরীর সর্বস্বতার সংকীর্ণ মানসিকতার থেকে তার উত্তরণ ঘটে নি । ফলে ভুসুকুর হরিণা ও কবিতা সিংহের একাকী নারী একাত্ম হয়ে গেছে ।