HEADER ADDS

বাচ্য-বাচ্যের শ্রেণিবিভাগ ও বাচ্য পরিবর্তন বা বাচ্যান্তর

      বাচ্য-বাচ্যের শ্রেণিবিভাগ ও বাচ্য পরিবর্তন বা বাচ্যান্তর 

     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন –‘কথা হল ভাবের আশ্রয় স্বরূপ।‘ এই কথা হল বলার ভঙ্গি বা রীতি । আমরা একই কথা কত রকম ভাবে বলে থাকি । প্রচলিত প্রবাদে আছে ‘কথা কইতে জানতে হয়,কথা শত ধারায় বয় ।‘ অনেক সময় আমরা সরাসরি কথা বলি,কখনো আবার ঘুরিয়ে কথা বলি । এবং এই ভাবে কথা বলার জন্য বাক্যের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে যায় কিন্তু অর্থের কোনো পরিবর্তন হয় না । ক্রিয়ার কালগত কোনো পরিবর্তন হয় না , ক্রিয়ার ভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না । বাক্যের গঠনে ক্রিয়াপদ ও শব্দের পরিবর্তন ঘটে যায় । পরিবর্তন ঘটে বাচনভঙ্গির । এই বাচনভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য ক্রিয়ার রূপভেদ ঘটে । ক্রিয়ার এই রূপভেদ অনুযায়ী বাক্যে কখনো কর্তা,কখনো কর্ম, কখনো ক্রিয়ার ভাবের প্রাধান্য লক্ষিত হয় । এই কথা বলার বিশেষ ভঙ্গি বা রীতি হল এককথায় বাচ্যবাচ্য  কথাটির ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করলে পাই বচ্‌ + ণ্যৎ ।  সাধারণ ভাবে বাচ্য কথার অর্থ হল যা বলা যায় । কিন্তু বাচ্য হল একই কথা নানাভাবে বলার ব্যাকরণগত উপায় ।

 

বাচ্য কাকে বলে ?

  ক্রিয়ার যে রূপভেদ দ্বারা ক্রিয়ার ক্রিয়ার সম্বন্ধ বা অন্বয় প্রধান ভাবে কর্তার বা কর্মের সঙ্গে সূচিত হয় অথবা ক্রিয়ার ভাব প্রধানভাবে সূচিত হয় , সেই রূপভেদকে বাচ্য বলে ।

 

 বাচ্যের ভিডিও ক্লাস দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন ।

বাচ্যের শ্রেণিবিভাগ –

১) কর্তৃবাচ্য

২) কর্মবাচ্য

৩) ভাববাচ্য

৪) কর্ম-কর্তৃবাচ্য

 

১) কর্তৃবাচ্য – যে বাচ্যে ক্রিয়াপদ কর্তার সঙ্গে প্রধানভাবে অন্বিত হয় ,অর্থাৎ ক্রিয়াপদ কর্তার অনুগামী হয় তাকে কর্তৃবাচ্য বলে ।

 

বৈশিষ্ট্য –

১) ক্রিয়াপদ কর্তার অনুসারী হয় ।

২) কর্তৃবাচ্যের কর্তায় সাধারণত শূন্য বিভক্তি হয় ।

৩) উদ্দেশ্য ও ক্রিয়ার সমন্বয় ঘটে ।

৪) কখনো কখনো কর্তৃপদে ‘এ’ , ‘য়’ বিভক্তি যুক্ত হয় ।

৫) কর্তার পুরুষ অনুযায়ী ক্রিয়াপদ পরিবর্তিত হয় ।

     যেমন – আমি ভাত খাই । ( উত্তম পুরুষ )

                  তুমি ভাত খাও   ( মধ্যম পুরুষ )

                  সে ভাত খায়     ( প্রথম পুরুষ )  

৬) কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া সকর্মক ,অকর্মক ও দ্বিকর্মক হতে পারে ।

     যেমন – আমি ভাত খাই । ( সকর্মক )

                  সে হাসে । ( অকর্মক )

                  তিনি আমাকে একটি কলম দিলেন । ( দ্বিকর্মক )

           কর্তৃবাচ্য  দুই ভাগে বিভক্ত

ক)সম্পাদক কর্তা কর্তৃবাচ্য বা সাধক কর্তা কর্তৃবাচ্য

কর্তা যখন নিজে ক্রিয়া সম্পাদন করে তখন তাকে  সম্পাদক কর্তাকর্তৃবাচ্য বলে। এক্ষেত্রে ক্রিয়াকে ‘কে’ বা  ‘কারা’  দিয়ে প্রশ্ন করে কর্তাকে পাওয়া যায় । কর্তৃবাচ্যের কর্তাকে সম্পাদক কর্তা কর্তৃবাচ্য বলে ।

খ) অসম্পাদক কর্তা কর্তৃবাচ্য বা সাধিত কর্তা কর্তৃবাচ্য

কর্তৃবাচ্যের কর্তার বদলে কর্ম যখন কর্তার স্থান দখল করে , তখন সেই বাচ্যকে অসম্পাদক কর্তাকর্তৃবাচ্য বলে। কর্তা ক্রিয়া সম্পাদন করে , কর্ম কখনো ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না । তাই কর্ম কর্তার স্থান দখল করলে তাকে অসম্পাদক কর্তাকর্তৃবাচ্য বলে    কর্মকর্তৃবাচ্য এই শ্রেণির উদাহরণ । তবে বাচ্যের আধুনিক ধারণা অনুযায়ী কর্মবাচ্যও এই শ্রেণিতে পড়ে ।

 

 

২) কর্মবাচ্য – যে বাচ্যে কর্মের প্রাধান্য থাকে এবং ক্রিয়া কর্মের অনুসারী হয় ,তাকে কর্মবাচ্য বলে ।

 

বৈশিষ্ট্য –

১) ক্রিয়াপদ কর্মপদের পুরুষ ও বচন অনুসারে রূপলাভ করে ।

২) কর্তৃবাচ্যের কর্তা সাধারণত অনুক্ত কর্তা হিসাবে উপস্থিত থাকে ।

৩) কর্তায় সাধারণত দ্বারা,দিয়া,কর্তৃক অনুসর্গ অথবা কে,র বা এর বিভক্তি যুক্ত হয় ।

৪) কর্মবাচ্যের ক্রিয়া সবসময় সকর্মক হয় ।

৫) কর্মবাচ্যের কর্ম ‘শূন্য’ বিভক্তযুক্ত হয়ে কর্তায় পরিণত হয় ।

৬) কর্মবাচ্যের ক্রিয়া ‘হ’ , ‘যা’ , ‘আছ্‌’ ধাতু যোগে গঠিত হয় ।

৭) সংস্কৃত রীতির তৎ সম ধাতুর ক্রিয়ায় ‘ক্ত’ প্রত্যয় এবং বাংলা ধাতুর ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘আ ‘ প্রত্যয় হয় ।

যেমন- বাল্মীকি কর্তৃক রামায়ন রচিত হয় ।

            পুলিশ কর্তৃক চোর ধৃত হইল ।

             কাজটা আমাকেই করতে হবে ।

             তাকে টিকিট কিনতে হয় নি ।

 

 

৩) ভাববাচ্য – যে বাক্যে ক্রিয়ার দ্বারা কর্তা বা কর্ম কারও প্রাধান্য সূচিত না হয়ে ক্রিয়ার ভাবটিই প্রাধান্য পায়,তাকে ভাববাচ্য বলে ।

 

বৈশিষ্ট্য –

১) ক্রিয়ার ভাব প্রাধান্য পায় । ‘ভাব’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ হল ক্রিয়া ।

২) কর্তায় সাধারণত ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্তি হয় ।

৩) ভাববাচ্যের ক্রিয়া সাধারণত অকর্মক হয় ।

৪) কখনো কখনো ক্রিয়ার কর্ম থাকে , সেখানে কর্ম ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ।

৫) কর্তা উহ্য থাকতে পারে ।

৬) কর্ম ক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে গেলে কর্তা অবশ্যই উহ্য থাকে ।

৭) সমাপিকা ক্রিয়াটি ‘হ’ ধাতু নিষ্পন্ন হয় । কখনো কখনো ‘যা’ , চল্‌’ , ‘পা’ ধাতু নিষ্পন্ন হয় ।

 

যেমন- আজ তোমার যাওয়া হবে না ।

           আপনার কোথায় থাকা হয় ।

           কী বিপদেই পড়া গেল ।

           তোমার কী রাগ হয়েছে ।

 

ভাববাচ্যের শ্রেণিবিভাগ

 

১: গৌণকর্ম-কর্তা ভাববাচ্য:  সাধারণত সমাপিকাকে কে বা কারা দিয়ে প্রশ্ন করলে বাক্যের কর্তা পাওয়া যায় । এই প্রকার ভাববাচ্যে 'কাকে' প্রশ্নের উত্তরে কর্তাকে পাওয়া যায়। বাক্যের কর্তাটিকে গৌণকর্ম বলে মনে হয় ।

কর্তায় 'কে' বা 'এ' বা 'য়' বিভক্তি যুক্ত হয়।

যেমন: আমাকে আজ এ কাজ শেষ করতেই হবে।

         তোমাকে যে কোনোভাবে আসতেই  হবে।

 

২) সম্বন্ধ-কর্তা ভাববাচ্য: এই ধরনের ভাববাচ্যে কর্তায় সম্বন্ধ পদের বিভক্তি 'র', 'এর', 'দের' যুক্ত হয়। কর্তাকে সম্বন্ধ পদ বলে ভ্রম হয়।

 

যেমন:   আমার যাওয়া হবে না।

           ‘তোমার হল শুরু আমার হল সারা। ’

 

৩) লুপ্ত-কর্তা ভাববাচ্য- ভাববাচ্যে অনেক সময় কর্তা উহ্য থাকে ।  কর্তাহীন ভাববাচ্যকে লুপ্ত-কর্তা ভাববাচ্য বলে ।

 

যেমন: এবার খাওয়া হোক ।

          ‘ ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার ’

          

 

 

 

৪) কর্ম-কর্তৃবাচ্য – যে বাক্যে কর্তার উল্লেখ থাকে না , কর্মপদ কর্তৃপদ অধিকার করে আছে বলে মনে হয় ,তাকে কর্ম-কর্তৃবাচ্য বলে ।

 

বৈশিষ্ট্য –

১) কর্ম-কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়াকে সকর্মক হতে হবে ।

২) ক্রিয়াকে কী ও কে দিয়ে প্রশ্ন করলে যদি একই উত্তর আসে তাহলে কর্ম-কর্তৃবাচ্য বলে ।

৩) কর্ম-কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া প্রথম্ পুরুষের হয় ।

 

যেমন- বাঁশি বাজে ।

             পায়ের শিকল কাটিল না ।

             গাড়ি চলে ।

 

 

বাচ্য পরিবর্তন বা বাচ্যান্তরের নিয়ম

 

এক বাচ্য থেকে অন্য বাচ্যে পরিবর্তন করাকে বাচ্যান্তর বা বাচ্য পরিবর্তন বলে । বাচ্য পরিবর্তনে উদ্দেশ্যপদ,কর্ম ও বিধেয়ক্রিয়ার পরিবর্তন হয় ।ক্রিয়ার কাল,ভাব এবং প্রকার অপরিবর্তিত থাকে ।

 

 

কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্যে পরিবর্তন

 

১) কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া কে অবশ্যই সকর্মক হতে হবে নাহলে  কর্মবাচ্যে রূপান্তর করা যাবে না .কর্তৃবাচ্যের কর্তা অকর্মক হলে ভাববাচ্যে রূপান্তর করা হয় 

২) কর্তৃবাচ্যের কর্তার সঙ্গে র ,এর বিভক্তি যুক্ত হয়।

যেমন- রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি রচনা করেন । > রবীন্দ্রনাথের দ্বারা গীতাঞ্জলি রচনা করা হয় । এখানে কর্তৃবাচ্যের কর্তা রবীন্দ্রনাথ -এর সঙ্গে ‘র’  বিভক্তি যুক্ত হয়েছে ।

৩) কর্তৃবাচ্যের কর্তা দ্বারা, দিয়া্‌ কর্তৃক অনুসর্গ যুক্ত হয় ।

যেমন- রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি রচনা করেন । > রবীন্দ্রনাথে কর্তৃক গীতাঞ্জলি রচিত হয় ।

এখানে কর্তৃবাচ্যের কর্তা রবীন্দ্রনাথ -এর সঙ্গে ‘দ্বারা’  অনুসর্গ যুক্ত হয়েছে ।

 

৪) কর্তৃবাচ্যের কর্ম কর্মবাচ্যের উদ্দেশ্য পদ হয় । কর্মকে বিভক্তি শূন্য করতে হয় ।

৫) কর্তৃবাচ্যের   বিধেয়  ক্রিয়া দ্বিকর্মক হলে কর্মবাচ্যে মুখ্যকর্ম কর্তা  হয়,গৌণ  কর্মের পরিবর্তন হয় না ।

৬)  কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়ার যে ধাতু তার সঙ্গে আ, আন , তে ,ইতে প্রত্যয় যুক্ত হয.।

 

  কর্মবাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তরের নিয়ম

১) কর্তৃবাচ্যের কর্তা কে কর্মবাচ্যের কর্ম করতে হয় ।

২) বিভক্তি বা অনুসর্গ যুক্ত ক্রিয়ার কর্তৃপদকে উদ্দেশ্য পদ রূপে প্রয়োগ করতে হয় এক্ষেত্রে বিভক্তি ও অনুসর্গ কে    

    বাদ দিতে হয় ।

৩) কর্মবাচ্যের সমাপিকা ক্রিয়া বাদ দিয়ে কৃদন্ত পদের মূল ধাতু থেকে সমাপিকা ক্রিয়া গঠন করতে হয় ।

৪) যুক্ত ক্রিয়ার কর্মবাচ্যে প্রথম পদটি প্রত্যয়হীন হবে এর সঙ্গে কর্তা অনুযায়ী সমাপিকা ক্রিয়া  হবে ।



  কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে রূপান্তর

১) ভাববাচ্যে অনেক সময় কর্তা উহ্য থাকতে পারে ।

২) কর্তৃবাচ্যের কর্তা সঙ্গে র , এর , কে বিভক্তি যোগ করতে হয় ।

যেমন -  আমি যাব > আমাকে যেতে হবে ।

            আপনি কোথায় থাকেন > আপনার কোথায় থাকা হয় ।

প্রথম উদাহরণটিতে ‘কে’ বিভক্তি ও দ্বিতীয় উদাহরণটিতে ‘র’ বিভক্তি যুক্ত হয়েছে ।

 

৩) কর্তৃবাচ্যের সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে আ, অন, আনো কৃৎপ্রত্যয় যোগ করে কৃদন্ত পদ গঠন করতে হয়।

যেমন – আপনি কোথা থেকে আসছেন । > আপনার কোথা থেকে আসা হচ্ছে ।

৪) ‘হ’ বা  ‘যা’ ধাতু থেকে সমাপিকা ক্রিয়া গঠন করতে হয় ।

যেমন - আপনি কোথা থেকে আসছেন । > আপনার কোথা থেকে আসা হচ্ছে ।

 

 

ভাববাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তরের নিয়ম

১) ভাববাচ্যের কর্তা কে বিভক্তি শূন্য  করতে হয় ।

যেমন- মহাশয়ের বসা হোক > মহাশয় বসুন ।

 এখানে ‘মহাশয়’ বিভক্তশূন্য হয়েছে ।

২) ভাববাচ্যের ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মকে পৃথক করতে হয় ।  

৩) ভাববাচ্যের ক্রিয়া বহুপদী ক্রিয়া বিলুপ্ত হয় তার পরিবর্তে একপদী ক্রিয়া করতে হয় । ( দেখা আছে > দেখেছে )

৪) ‘হ’ ধাতু নিষ্পন্ন সমাপিকা ক্রিয়াটি লুপ্ত হয় । যুক্ত ধাতুর মূল ধাতু থেকে কর্তা অনুযায়ী ক্রিয়া করতে হয় ।

    যেমন – আকাশে ক্ষীণ চাঁদটির ওঠা হয় > আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে ।