অব্যয়ের সংজ্ঞা ও শ্রেণিবিভাগ
অব্যয় কী -
পদ
দুই প্রকার – অব্যয় পদ ও সব্যয় পদ । কোনো শব্দ বাক্যে ব্যবহৃত হলে তখন তাকে আমরা পদ
বলে থাকি । শব্দ বিভক্তি যুক্ত হয়ে বাক্যে ব্যবহারের যোগ্যতা লাভ করে । অর্থাৎ বিভক্তিযুক্ত
শব্দকে পদ বলে । বিশেষ্য,বিশেষণ,সর্বনাম, ক্রিয়া এই ধরণের পদ । কিন্তু কিছু শব্দ আছে
যেগুলি বাক্যে ব্যবহৃত হলেও তারা পূর্বাবস্থায় থাকে । এই সমস্ত পদে বিভক্তিযুক্ত হয়
না । এই পদগুলিকে আমরা অব্যয় পদ বলি । অব্যয়ের সঙ্গে কোনো বিভক্তি যেমন যুক্ত হয় না
তেমনি কোনো প্রত্যয়ও যুক্ত হয় না । বাক্যের কর্তা ও ক্রিয়া অনুসারে অব্যয়ের কোনো পরিবর্তন
হয় না । সংস্কৃত ব্যাকরণে অব্যয় সম্পর্কে বলা হয়েছে –
সদৃশং ত্রিষু লিঙ্গেষু সর্বাসু চ বিভক্তিসু।
বচনেষু চ সর্বেষু যন্নব্যেতি তদব্যয়ম্ ।।
অব্যয় কাকে বলে -
যে
সমস্তপদে বিভক্তি যুক্ত হয় না , লিঙ্গ-বচন-পুরুষভেদে যাদের কোনো পরিবর্তন হয় না তাদের
অব্যয় বলে । অব্যয় অর্থাৎ নাই ব্যয় যার।
বাক্যগত’উক্তিকে এবং বাক্যস্থ পদগুলির পারস্পরিক সম্বন্ধকে স্থান,কাল,পাত্র ও প্রকার বিষয়ে পরিস্ফুট করে দেয় যে পদগুলি ,তাদের অব্যয় বলে - সুনীতি কুমার চট্টোপাধায়
অব্যয়ের
প্রয়োজনীয়তা-
·
অব্যয় পদগুলি বাংলা ভাষায় একটি
পদের সঙ্গে অন্য একটি পদের,একটি বাক্যাংশ ও আর একটি বাক্যাংশ বা একটি বাক্যের সঙ্গে
অন্য একটি বাক্যের সম্বন্ধ স্থাপন করে ।
·
অব্যয় পদ্গুলি যেমন বিভিন্ন পদের
অন্বয় স্থাপন করে তেমনি বাক্যের শ্রুতিমাধুর্য বৃদ্ধি করে,অর্থসৌন্দর্য বৃদ্ধি করে
।
·
বাক্যের ভাব প্রকাশে সাহায্য
করে ।
অব্যয় বিষয়ে ONLINE TEST দেওয়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
বাংলা
শব্দভাণ্ডারে অব্যয় -
বাংলা শব্দভাণ্ডারে আমরা তিন ধরণের অব্যয় পাই - তৎসম অব্যয় , বাংলা অব্যয় এবং বিদেশি অব্যয় ।
তৎসম অব্যয় শব্দ: অথবা,যদি,কিন্তু,তথা,তথাপি,অর্থাৎ,অবশ,বিনা,কিম্বা ইত্যাদি ।
বাংলা অব্যয় শব্দ: কাজেই,না,তবু,কেন,কি,যেমন,আবার,মতো,নাই,বুঝি,তো ইত্যাদি।
বিদেশি অব্যয় শব্দ: আলবত, বহুত, খুব, শাবাশ, খাসা, মাইরি, ইত্যাদি।
বিবিধ উপায়ে গঠিত অব্যয় শব্দ
১.
একাধিক অব্যয় শব্দযোগে : কদাপি, নতুবা, অতএব, অথবা ইত্যাদি।
২.
আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশক একই শব্দের দুইবার প্রয়োগে : ছি ছি, ধিক্ ধিক, বেশ বেশ ইত্যাদি।
৩.
দুটি ভিন্ন শব্দযোগে : মোটকথা, হয়তো, যেহেতু, নইলে ইত্যাদি।
৪.
অনুকার শব্দযোগে : কুহু কুহু, গুন গুন, ঘেউ ঘেউ, শন শন, ছল ছল, কন কন ইত্যাদি।
অব্যয়ের শ্রেণিবিভাগ -
অব্যয়
প্রধানত চার প্রকার:
১.
পদান্বয়ী অব্যয়
২.
সমুচ্চয়ী অব্যয়
৩.
অনন্বয়ী অব্যয়
৪.
অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়।
১. পদান্বয়ী অব্যয় –
পদান্বয়ী কথাটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা পদ ও অন্বয়ী দুটি
অংশ পাই । অর্থাৎ পদের মধ্যে অন্বয় সাধন করে যে । তাই আমরা বলতে পারি –
যে অব্যয় বাক্য মধ্যস্থ একটি
পদের সঙ্গে অন্য একটি পদের অন্বয় বা সম্বন্ধ স্থাপন করে ,তাকে পদান্বয়ী অব্যয় বলে ।
যেমন- হইতে,থেকে,চেয়ে,নিমিত্ত,বিনা,ব্যতীত,অবধি,সঙ্গে,দ্বারা
ইত্যাদি । মনে রাখতে হবে এই ধরণের অব্যয়গুলি ভাষায় অনুসর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয় ।
পদান্বয়ী অব্যয়গুলি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় ।
(ক) অবস্থানবাচক – ভিতর,ভিতরে,পশ্চাতে,সম্মুখে,সামনে,পাশে,নীচে,উপরে ইত্যাদি ।
দৃষ্টান্ত –
“খাঁচার
ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায় !” ,
“পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে ।“
“সম্মুখে বসায়ে রেখে কোলে দাও নাই স্থান ।
(খ) সীমানাবাচক – অবধি,পর্যন্ত,থেকে,ছাড়িয়ে,তক্ক,তক ইত্যাদি ।
দৃষ্টান্ত-
কত দূর অবধি আজ যেতে পারবি ?
লোকালয়ের সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূরে অবস্থিত।
(গ) ব্যতিরেকাত্মক – বিনা,বিহনে,ব্যতীত,বই,ছাড়া,ভিন্ন,বাদে,ব্যতিরেকে ইত্যাদি ।
দৃষ্টান্ত-
“দঃখ
বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে ?’
তার
আর এক বই দুই নাই ।
(ঘ) উপমাবাচক –
সম , মতো, মতন,তুল্য,যেন,প্রায়,হেন,পারা,প্রায় ইত্যাদি ।
দৃষ্টান্ত-
“বেতের
ফলের মতো ম্লান চোখ মনে আসে ।“
“ভুতের
মতন চেহারা তাহার নির্বোধ অতি ঘোর ।“
“যেমত যোগিনি পারা ।
নিমিত্ত,ভিতরে,বাহিরে,পশ্চাতে,দরুন,বাবদ,কারণে ইত্যাদি ।
দৃষ্টান্ত –
“ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার।”
“পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
২. সমুচ্চয়ী অব্যয় বা বাক্যান্বয়ী
অব্যয় বা সম্বন্ধবাচক অব্যয় : যে অব্যয়
পদ একটি বাক্যের সঙ্গে অন্য একটি বাক্যের অথবা বাক্যস্থিত একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি
পদের সংযোজন, বিয়োজন বা সংকোচন ঘটায়, তাকে সমুচ্চয়ী অব্যয় বা সম্বন্ধবাচক অব্যয়
বলে।
সমুচ্চয়ী
অব্যয় দু-প্রকার – (১) সহযোগী ও (২) অনুগামী
সহযোগী
সমুচ্চয়ী অব্যয় - পরস্পর নিরপেক্ষ একাধিক বাক্যকে যে অব্যয় যুক্ত করে
তাকে সহযোগী সমুচ্চয়ী অব্যয় বলে ।
যেমন-
তিনি বাজারে গেলেন এবং আমি বাড়ি ফিরিলাম।
অনুগামী
সমুচ্চয়ী অব্যয় – একটি প্রধান বাক্যের সঙ্গে অপ্রধান
বাক্যকে যে অব্যয় যুক্ত করে তাকে অনুগামী সমুচ্চয়ী অব্যয় বলে ।
যেমন
– তিনি বললেন যে আমি দোষী ।
সমুচ্চয়ী অব্যয়ের প্রকারভেদ
-
ক. সংযোজক অব্যয়
যে অব্যয় বিভিন্ন বাক্যাংশ,বাক্য,পদকে যুক্ত করে তাকে সংযোজক অব্যয় বলে ।
যেমন- ও,এবং,আর,আরও,অপিচ,অধিকন্তু ,তথা ইত্যাদি ।
সীতা
ও গীতা গান গাইছে ।
রবীন্দ্রনাথ
বাংলা তথা ভারতের গৌরব ।
খ. বিয়োজক অব্যয় বা বৈকল্পিক
অব্যয় -
যে অব্যয় বিভিন্ন
বাক্যাংশ,বাক্য,পদকে বিযুক্ত করে তাকে বিয়োজক
অব্যয় বলে ।
যেমন- বা,অথবা,কিম্বা,নতুবা,হয়,না হয়,নহিলে,নয়ত,না ইত্যাদি
।
বিজ্ঞান
আশীর্বাদ না অভিশাপ ।
তুমি
অথবা
সে আসবে ।
গ. সংকোচক অব্যয়: যে অব্যয় বাক্যের অর্থকে সংকুচিত করে অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত ফলের বিপরীত ফল প্রকাশ
করে তাকে সংকোচক অব্যয় বলে ।
যেমন- কিন্তু,পরন্তু,বরং,বরঞ্চ,তথাপি,অথচ ইত্যাদি ।
লোকটি
দরিদ্র কিন্তু
সৎ ।
অনেক
চেষ্টা করেছে তথাপি সফল হলো না ।
ঘ. হেতুবাচক অব্যয়: যে অব্যয় হেতু বা কারণ
বোঝাতে ব্যবহৃত হয় তাকে হেতুবাচক অব্যয় বলে ।
যেমন-
কারণ,বলে,কেননা,এই জন্য,যেহেতু,এই হেতু ইত্যাদি ।
আমি
আজ যেতে পারছি না কারণ বৃষ্টি পড়ছে ।
তুমি
এসেছ বলে খুশি হয়েছি ।
ঙ. সংশয়সূচক অব্যয়: যে অব্যয় সংশয় বা সন্দেহ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় তাকে সংশয়সূচক অব্যয়
বলে ।
যেমন-
বুঝি,নাকি,হয়তো,তাই নাকি, ইত্যাদি ।
“ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে” ।
“শুনতে
পেলাম পোস্তা গিয়ে তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে” ।
চ. সিদ্ধান্তবাচক অব্যয়: যে অব্যয় সিদ্ধান্ত বোঝাতে
ব্যবহৃত হয় তাকে সিদ্ধান্তবাচক অব্যয় বলে ।
যেমন-
সুতরাং,বোধহয়,তাই,কাজেই,অতএব,কাজে কাজেই, ইত্যাদি ।
কাজ
আছে তাই আমাকে যেতেই হবে ।
বৃষ্টি
পড়ছে সুতরাং যাওয়া হবে না ।
ছ. নিত্যসম্বন্ধী অব্যয় বা সাপেক্ষ অব্যয়: যে সকল অব্যয় পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত
অর্থাৎ একটিকে ব্যবহার করলে আর একটিকে ব্যবহার করতেই হয় তাকে নিত্যসম্বধী অব্যয় বলে
।
যেমন-
যেমন- তেমন , যত-তত , যখন – তখন , ইত্যাদি
।
যত
মত তত পথ ।
যখন তোমার বাড়ি গিয়ে ছিলাম তখন তুমি পড়ছিলে ।
জ. ব্যতিরেকাত্মক অব্যয়: যে অব্যয় অভাব বা ভেদের
অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় তাকে ব্যতিরেকাত্মক অব্যয় বলে ।
যেমন-
নহিলে,নতুবা,নচেৎ , নইলে , যদি না ইত্যাদি ।
পরিশ্রম কর নতুবা আশানুরূপ ফল পাবে না ।
কাজ
কর নচেৎ বাইরে যাও ।
৩. অনন্বয়ী অব্যয়: যে সকল অব্যয় বাক্যের
অন্য পদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ না রেখে স্বাধীনভাবে নানাবিধ ভাব প্রকাশে ব্যবহৃত হয়,
তাদের অনন্বয়ী অব্যয় বলে। এই ধরণের অব্যয়ের সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের কোনো ব্যাকরণগত
সম্বন্ধ থাকে না ।
অনন্বয়ী
অব্যয় চার ধরণের –
ক।
ভাবপ্রকাশক অব্যয়
খ।
সম্বোধনসূচক অব্যয়
গ।
প্রশ্নবাচক অব্যয়
ঘ।
বাক্যালঙ্কার অব্যয়
ক।
ভাবপ্রকাশক অব্যয়- যে অব্যয় মনের বিভিন্ন ধরণের
ভাব প্রকাশ করে তাকে ভাবপ্রকাশক অব্যয় বলে । আনন্দ,বেদনা,হর্ষ,বিষাদ,ঘৃণা,বিষ্ময়,ক্রোধ
ইত্যাদি এই অব্যয়ের দ্বারা প্রকাশ পায় ।
যেমন-
আচ্ছা,বেশ,বাঃ,চমৎকাত,উঃ,ও বাবা, ও মা, হায় হায় , আহা রে ইত্যাদি ।
বাঃ
! খুব সুন্দর পাখি ।
“ও
বাবা !মড়াৎ করে পড়েছি সড়াৎ জোরে ।
খ।
সম্বোধনসূচক অব্যয় – যে অব্যয় দিয়ে কাউকে সম্বোধন
করা হয় , তাকে সম্বোধনসূচক অব্যয় বলে ।
যেমন-
হে,ওহে,ওগো,রে,ওরে,অয়ি,ওলো,এ,ও ইত্যাদি ।
“রে
প্রমত্ত মন মম , কবে পোহাইবে রাতি ?”
“ওগো
,আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে ।”
গ।
প্রশ্নবাচক অব্যয় – জানার ইচ্ছা বা আগ্রহ প্রকাশের
জন্য যে অব্যয় ব্যবহার করা হয়,তাকে প্রশ্নবাচক অব্যয় বলে ।
যেমন-
কি,কেন,না,বটে ইত্যাদি ।
তুমি
খাবার খাচ্ছ না কেন ?
সে
ঘুমিয়ে পড়েছে কি ?
ঘ। বাক্যালংকার অব্যয়: যে অব্যয় বাক্যের অর্থের পরিবর্তন না করে শুধু বাক্যের অর্থসৌন্দর্য
বৃদ্ধি করে, তাকে বাক্যালংকার অব্যয় বলে। এই অব্যয়গুলির নিজস্ব কোনো অর্থ থাকে না
, কিন্তু বাক্যের অর্থের বৈচিত্র সম্পাদন করে ।
যেমন-
তো,তাই,না,আর,যে ইত্যাদি ।
“এ
তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয় ।”
“কত না
দিনের দেখা,কত না রূপের মাঝে
!”
৪. ধ্বন্যাত্মক অব্যয়: যে সকল অব্যয় কোনো বাস্তব ধ্বনি অথবা অনুভূতিগ্রাহ্য ভাবের
ব্যঞ্জনা প্রকাশ করে তাকে ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বলে।
যেমন-
খাঁ খাঁ ,কল্কল,শনশন,বোঁ বোঁ , টিপ্টিপ,টাপুরটুপুর,কনকন , টপাটপ,বকবক , ফিসফিস ইত্যাদি
।
“ঝকঝক
কলসির বকবক শুন গো।”
“হেসে
খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। ”
“টাপুর-টুপুর
সারা দুপুর নূপুর বাজায় কে ?”
“রুনুঝুনু
রবে বাজে আভরণ। ”
“ঢলঢল
কাঁচা অঙ্গের লাবণি অবনী বহিয়া যায়।”