HEADER ADDS

কাল মধুমাস – সুভাষ মুখোপাধ্যায়

কাল মধুমাস – সুভাষ মুখোপাধ্যায়

 

যৌবন বিদায় নিয়ে

এতক্ষণে পৌঁছে গেছে

যেখানে যাবার

মিষ্টি হেসে

হাত নেড়ে তাকে বলেছিলাম,বিদায়!

মেয়েলি ঈর্ষায়

প্রৌঢ়ত্বও করছে যাব যাব ।

উল্লিখিত অংশটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাল মধু মাস কবিতার অংশ । কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে । সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন । প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি এই কথা গুলো বলেছেন । সময় ব্যক্তি নিরেপেক্ষ । সময়ের বোধও আপেক্ষিক । তাই অন্যের চোখে সময় যে ভাবে ধরা পড়ে , সকলের কাছে সে ভাবে নাও হতে পারে। তাই বয়স দিয়ে সময়কে তাই মাপা যায় না. সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন ‘’তোমার সময় দিয়ে তাই বৃথা চেষ্টা আমাকে  মাপবার’’ জীবনকে তিনি পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে চেয়েছেন । কারণ-

 বারবার ফিরে আসা নয়

 পারাপার

 নয়

 শুধু যাওয়া।

 জীবনে একবার মাত্র সুযোগ আসে,তাই    মরতে মরতে নয় নেচে নেচে ঢেউয়ের মাথায় উচ্ছল জীবনযাপন করে তিনি যেতে চান। কবিতাটি  আত্মজৈবনিক মূলক কবিতা।ছটি পর্যায়ে বিভক্ত এই দীর্ঘ কবিতায় কবি স্মৃতিচারণা করেছেন । জীবনকে নিয়ে কোনো আক্ষেপ তিনি করতে চান না কোন বিদ্রুপ করতে চান না ,হালে পানি- পালে হাওয়া লাগুক আর না লাগুক জীবনের সহজ মাধুর্যকে তিনি আকন্ঠ পান করতে চান। জীবনের আনন্দ এবং দুঃখ কে গুরুত্ব না দিয়ে দিন চলে যাওয়াকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। 

সময় তো জানোই -

নয় ব্যাকরণের অব্যয়

যখন যে পথে থাকে

 সেইমতো আকার

 

 

আরও পড়ুন -

         কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। মিশে যান কৃষকের সাথে কখনো শ্রমিকের সাথে, বিকেলে মিছিল থাকলে সারিবদ্ধ দুই হাত দোলাতে দোলাতে কখন মিছিলের সব লোকের সঙ্গে একাকার হয়ে যান। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।  সুভাষ মুখোপাধ্যায় রাজনীতিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাই রাজনীতিতে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থপরতাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। আদর্শ এবং নীতি থেকে সরে আসেন নি ।  ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেও তিনি তার বিশ্বাস তার আদর্শ থেকে সরে আসেননি। 

শৈশবের স্মৃতি এই কবিতায় বারবার থেকে ফিরে এসেছে অশ্রুকুমার সিকদারআধুনিক কবিতার দিগবলয়গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন

   “সময়ের পলায়মানতার বোধ এত তীব্র বলেই বারবার ঘুমকাতুরে গৃহমুখী নস্টালজিয়ার ছায়াপাত হয় ইদানিং শেষবারের মতো একবার পুরনো ছবিগুলি মিলিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। সেই ইচ্ছেরই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রকাশকাল মধুমাসনামে দীর্ঘ আত্মজৈবনিক কবিতাটি।

 

       কবিতাটির তৃতীয় পর্যায়ে আমরা দেখেছি চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে জীবনের গতিশীলতার তুলনা করেছেন কবি কিন্তু এই গতিশীলতা সামনের দিকে নয় ,পিছনের দিকে স্মৃতির সরণি বেয়ে ফিরে গেছেন শৈশবের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিতে কবি জীবন গতিপথের উল্টো দিকে লক্ষ্য করেছেন একা জেগে বসে থাকা একটি শিশুর এবং এক পৈশাচিক উৎসবে মেতে থাকা দাদা দিদি কাকা বাবা যারা হাজার ডাকেও উঠবে না সে জানে না কোথায় চলেছে অন্ধকার তার স্বপ্নেও ছিলনা হিসেবেও ছিল না কিন্তু সেই অন্ধকারের ভয়ংকর আত্মা কে স্বীকার করতেই হয়। কবিতাটির চতুর্থ পর্যায়ে আমরা মফস্বলের এক নগণ্য শহর নওগাঁ এবং রেইনট্রি গাছের ছায়া সেখানকার গলায় ঘন্টা হাতি বোতাম ফুল হারাধন বাবু বিভিন্ন স্মৃতি কবিকে ভারাক্রান্ত করেছে । নিজের জন্মগত একটি ছবির কথা বলেন তিনি-

 কী করে জানিনা –

আমার মনের মধ্যে জন্মগত  ছবি একটা আছে

একেবারে শীতের শেষদিন।

পাতা নেই গাছে।

দুটি ঠোঁট শব্দ তোলে অন্য দুটি ঠোঁটে

বলে ওঠে

‘মনে নেই ? কাল মধুমাস’!

        কিন্তু একথা কবিকে অন্য কেঊ বলেছিল, কবির মা নন ।  শীতের রুক্ষতার শেষে বসন্ত আসে । শীতের শেষদিন মানে মাঘ মাসের সংক্রান্তি । সংক্রান্তি মানেই সন্ধিক্ষণ । শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয় , শীতের অবসানে সারা পৃথিবীর আঙিনায় অনাগত বসন্তের কামনা করেছেন কবি । কবির মা তখন কবিকে নিয়ে যন্ত্রনায় নীল । শুধু ব্যক্তিগত জীবনকেই নয় , একটি চলমান উন্মুখর সময়কেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন কবি । কবির জন্মের কিছু আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে । তাই সন্তানের চিন্তায় মা  ব্যাকুল । মা-এর কোল পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় । তাই হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালে মায়ের ‘জয়মণি! স্থির হও।‘ নিরাপত্তার অনুভুতি নিয়ে আসত ।  ব্যক্তিগত জীবনে এই অভয় মন্ত্রটাই পেতে চেয়েছেন- কারণ এই মন্ত্রই কবিকে কবিকে সমকালীন বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবে । সন্তানের ভবিষ্যত দিনের আশঙ্কায় মা-ও যন্ত্রনায় নীল ।

কিন্তু কবি বিশ্বাস করেন শীত রাত্রির অবসানে মধুমাস আসবে,এবং তা কিন্তু বেশি দূরে নেই । তার আগমন শুধু সময়ের অপেক্ষা – কারন ‘কাল মধুমাস’

 

 

 

 

 

 

 

তথ্যঋণ – বাংলা কবিতা -পর্বে পর্বান্তরে – ধ্রুব কুমার মুখোপাধ্যায়