কমা পেলে একটু থেমে,
দাঁড়ি পেলে দাঁড়াই।
‘কোলন’ ‘সেমিকোলন’ পেলে
জিরিয়ে পা বাড়াই।
বিরাম চিহ্ন সম্পর্কে L Tipping বলেছেন
-When we speak, we naturally make pauses and stops for an unbroken stream of words tends to become a mere unintelligible gabble. In writing we make these natural pauses by means of stops.
ভাষায় সার্থক বাক্য পরম্পরার মধ্যস্থতায় মনের ভাব প্রকাশ করা হয়।মনের ভাব প্রকাশে বাক্যস্থিত শব্দ গুলিতে ঝড়ের বেগে অনর্গল উচ্চারণ করে গেলে অর্থ পরিস্ফুটন ব্যাহত হয়। তাছাড়া মানুষের বাগযন্ত্রের কার্যকারিতায় শ্বাস বায়ুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।ভাবের বা অর্থের পরিস্ফুটন এর দিকে লক্ষ্য রেখে শ্বাস গ্রহণের জন্য বাগযন্ত্রকে উপযুক্ত স্থানে থামতে হয় বা এমন ভাবে থামতে হয় যাতে অর্থ বা ভাবের পরিস্ফুটন ব্যাহত না হয়ে সহজ ও সাবলীল হয়। এই থামা বা বিরামের ব্যবহার কে বলা হয় বাক্যের বা বাক্যাংশের যতি।
উপযুক্ত স্থানে যতি বা বিরাম চিহ্ন ব্যবহার না করলে বাক্যের অর্থবোধ কষ্টকর হয় এবং অভিপ্রেত অর্থ না বুঝিয়ে অন্য অর্থ বোঝায়।
বিজ্ঞাপন দিবেন না ,দিলে ১০০ টাকা জরিমানা।
বিজ্ঞাপন দিবেন, না দিলে ১০০ টাকা জরিমানা।
সামান্য একটি কমার হেরফের এ বাক্যের অভিপ্রেত অর্থের পরিবর্তন ঘটে গেছে।
তাই বিরাম চিহ্ন বা যতি চিহ্নের ব্যবহার অত্যাবশকীয়। বিরাম চিহ্ন বা যতি চিহ্ন কে প্রধানত দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—
১) বাক্য শেষের যতি ।
২) বাক্যের আভ্যন্তরীণ যতি ।
বাক্য শেষের যতি তিন প্রকার-
১) পূর্ণচ্ছেদ
২) প্রশ্নচিহ্ন
৩) আবেগ চিহ্ন বা বিস্ময় সূচক চিহ্ন
পূর্ণচ্ছেদ:-
১) বিবৃতিমূলক বাক্য বা নির্দেশক বাক্য অনুজ্ঞাসূচক বাক্য ইচ্ছা সূচক বাক্য সম্পূর্ণরূপে শেষ হলে দাড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ বসে।
ক) বাঙ্গালী আবেগপ্রবন জাতি।
খ) তুমি খেয়ে নাও।
গ) ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
২) বাক্য সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেলে দাঁড়ি বসে। বাক্যের সমাপ্তি এবং নতুন বাক্যের সূচনায় নির্দেশ করে দাঁড়ি। দীর্ঘতম বিরামের প্রতিরুপ হয় দাঁড়ি। যেখানে একটি পূণবাক্য বা প্রসঙ্গ শেষ হয় সেখানে দাঁড়ি বসে। দাঁড়ি চিহ্নের বিরামের (থামার) সময় ১ সেকেন্ড।
প্রশ্ন চিহ্ন:-
১) কোন কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে অর্থাৎ কোন বিষয়ে কিছু জানতে চাওয়া হলে বাক্যের শেষে প্রশ্ন চিহ্ন বসে।
ক) তোমার নাম কি?
২) সন্দেহ বোঝাতে বাক্যের মধ্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসে।
যেমন- খ) এটা তোমার বই? ঠিক তো ?
বিস্ময়সূচক চিহ্ন বা আবেগ সূচক চিহ্ন:-
১) আবেগসূচক বাক্য হলে আবেগ সূচক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের বাক্যে হর্ষ-বিষাদ বিস্ময় ঘৃণা ক্ষোভ ধিক্কার ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। সাধারণত বিভিন্ন ধরনের অব্যয় এর পরে বা কখনো কখনো বাক্যের শেষে এই চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
ক) হায় !হায় ! লোকটি মারা গেল।
খ) আজ আমাদের কী আনন্দের দিন!
২) কখনো কখনো কাউকে আহবান সম্মোধন বা সম্ভাষণ করলে সম্বোধনসূচক শব্দের পরে আবেগ চিহ্ন বসে এবং বাক্যের শেষে পূর্ণচ্ছেদ বসে। তবে আধুনিক বাংলাতে সম্বোধনসূচক শব্দের পরে কমা দিয়ে বাক্যের শেষে আবেগ চিহ্ন বসে ।
গ) মহাশয় !আমার কথাটা শুনুন।
ঘ) সত্যি সেলুকাস ,কি বিচিত্র এই দেশ!
বাক্যের আভ্যন্তরীণ যতি
কমা / পাদচ্ছেদ (,)
১) বাক্য পাঠকালে সুস্পষ্টতা বা অর্থ
বিভাগ দেখানোর জন্য যেখানে স্বল্প বিরতির প্রয়োজন, সেখানে কমা ব্যবহৃত হয়।
২) শুধু শেষ বিশেষ্য বা বিশেষণ পদ
ছাড়া, বাক্যের অন্তর্গত একাধিক বিশেষ্য বা বিশেষণ পদের শেষে কমা ব্যবহার করা হয়।
৩) সম্বোধনের পর কমা বসে।
যেমন- সে বলিল , ‘ বাবুজি, সজারুর
মাংস খান?”
৪) প্রত্যক্ষ উক্তির পূর্বে কমা বসবে।
রাজপুত বলিলেন, “তুমি আমাকে চেন?”
৫) খন্ডবাক্যের পর কমা বসে।
৬) মাসের তারিখ লিখতে বার ও মাসের পর
কমা বসবে।
যেমন- ২৫ শে বৈশাখ,১২৬৮ বঙ্গাব্দ,
সোমবার
৭) নামের পর ডিগ্রিসূচক পরিচয় সংযোজিত
হলে সেগুলোর প্রত্যেকটির পরে কমা বসবে।
যেমন- রাসবিহারী সেন , এম এ,বি এড,
এম ফিল, পি এইচ ডি
অর্ধচ্ছেদ বা সেমি কোলন (;)
দাঁড়ির চেয়ে কম
ও কমার চেয়ে বেশি বিরামকাল নির্দেশ করতে সেমিকোলন ব্যবহার করা হয় ।
১) একাধিক বাক্যের মধ্যে অর্থের নিকট
সম্বন্ধ থাকলে সেমিকোলন বসে ।
যেমন – “যাহা লঘু তাহা তো উঠিবেই;যাহা গুরু তাহা তো
নামিবেই;ইহাই তো প্রকৃতির নিয়ম ।“
২) দুটি বা তিনটি বাক্য সংযোজক
অব্যয়ের সাহায্যে যুক্ত না হলে সেমিকোলন ব্যবহৃত হয়।
যেমন- “আমাদের সাধ্য কম;কিন্তু
আমাদের সাধনা তার চেয়েও অনেক কম ।“
৩) ছোট ছোট বিতর্কিত অংশ নির্দেশ করার
জন্য সেমিকোলন বসে।
৪) সমজাতীয় দ্রব্য বা বিষয়কে আলাদা
করার জন্য সেমিকোলন বসে।
যেমন- “ বেলুন উপরে ওঠে বায়ু আছে
বলিয়া;শোলা জলে ভাসে জল আছে বলিয়া;লোহা পারায় ভাসে,পারা আছে বলিয়া;নতুবা সকলেই
ডুবিত,কেহই ভাসিত না; সকলেই নামিত,কেহই উঠিত না ।“
কোলন (:)
বাক্যের মধ্যে দুটি বক্তব্য বা
বাক্যাংশের মধ্যে কোলন বসে । একটি বাক্যাংশ থেকে আর একটি বাক্যাংশে যাওয়ার জন্য
কোলন ব্যবহার করা হয় । বাক্যে কোন প্রসঙ্গ অবতারণার আগে কোলন বসে।
১) যথা, যেমন, উদাহরণ ইত্যাদির পর কোলন
বসে।
যেমন – বেদ চার প্রকারঃ ঋক,সাম,যজু,অথর্ব
।
২) কোন উদ্ধৃতির আগে কোলন বসে।
যেমন- “সে বলবেঃ এই যে ধমকটা খেলেন,
সেটাই বা কম কী!”
৩) নাটকের সংলাপের আগে কোলন বসে।
যেমন- সিরাজঃ আমি আজ ধন্য! আমি
ধন্য!
৪) গণিতের অনুপাত বুঝাতে কোলন বসে
ইত্যাদি।
যেমন- ৫ঃ৩
ড্যাস (-)
ড্যাশ-চিহ্ন গতির প্রতীক ।
১) উদাহরণ দিতে বা তালিকা দিতে হলে তার
আগে ড্যাস চিহ্ন বসে।
যেমন- বর্ণাশ্রম চার প্রকার –
ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,শুদ্র ।
২) যৌগিক ও মিশ্র বাক্যে পৃথক ভাবাপন্ন
দুই বা তার বেশি বাক্যের সমন্বয় বা সংযোগ বোঝাতে ড্যাস ব্যবহৃত হয়।
৩) শূন্যস্থান পূরণের ক্ষেত্রে লুপ্ত
শব্দের স্থানে ড্যাস বসে।
৪) স্থান ও কালগত দূরত্ব বা ব্যবধান
নির্দেশ করতে ড্যাস বসে।
কোলন ড্যাস
(:-)
১) উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করতে
হলে কোলন ড্যাস বসে।
২) প্রসঙ্গের দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের
জন্য কোলন ড্যাস ব্যবহৃত হয়।
৩) শিরোনামের শেষে কোলন ড্যাস ব্যবহার
করা হয় ইত্যাদি।
হাইফেন বা
সংযোগ চিহ্ন (-)
১) সমাসবদ্ধ পদের অংশগুলো বিচ্ছিন্ন করে দেখানোর জন্য হাইফেন বা সংযোগ
চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
যেমন- সুখ-দুঃখ , আসল-নকল ।
২) দুটি শব্দের সংযোগ বা বিশ্লেষণ দেখানোর জন্য হাইফেন বা সংযোগ চিহ্ন
ব্যবহার করা হয়।
৩) কখনো কখনো উপসর্গের পর হাইফেন বসে।
যেমন- প্রহার= প্র-হৃ+ঘঞ
৪) কোন একটি বর্ণ অন্য শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত হলে হাইফেন বসে।
৫) কোন উল্লেখযোগ্য চুক্তি বা ঘটনার সাথে স্থানের নামের সংযুক্তিতে হাইফেন
বসে।
৬) দপ্তর অথবা প্রাতিষ্ঠানিক পদমর্যাদা বুঝাতে হাইফেন বসে।
৭) দুটি নাম বিশেষণের সংযোজনে হাইফেন বসে।
8) সংখ্যার সাথে শব্দের সংযোগ ঘটাতে হাইফেন বসে ইত্যাদি।
উদ্ধৃতি বা উদ্ধরণ চিহ্ন (” “)
১) বক্তার উক্তিকে অবিকৃতভাবে
উদ্ধার করতে এই চিহ্নের ব্যবহার করতে হয়।
যেমন- বাবু বলিলেন, “ ব্যাটা পাকা চোর অতিশয়।“
২) কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, বই, চলচ্চিত্র ইত্যাদির নাম ব্যবহারের সময়
উদ্ধরণ চিহ্ন বসে।
যেমন- “গীতাঞ্জলি” , “পথের
দাবী”
ব্র্যাকেট বা বন্ধনী চিহ্ন (), { } , [ ]
১) বাক্যের মধ্যে কোনো পদ বা বাক্যবন্ধকে ব্যাখ্যার জন্য আলাদা ভাবে উল্লেখ
করতে হলে সেটিকে বন্ধনী চিহ্নের মধ্যে রাখতে হয় । প্রথম বন্ধনীটি বিশেষ
ব্যাখ্যামূলক অর্থে সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
২) নাটকের সংলাপে চরিত্রের ক্রিয়া নির্দেশ করতে প্রথম বন্ধনী ব্যবহার করা
হয়।
৩) কখনো কখনো ব্যাখ্যামূলক বিষয় হিসেবে ৩য় বন্ধনী ব্যবহৃত হয় ইত্যাদি।