১) মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যের আধুনিকতা আলোচনা করো ।
প্রচলিত কাব্য প্রসঙ্গ কে গ্রহণ করলেও কবিকঙ্কন
এর প্রতিভার জাদুস্পর্শে চন্ডীমঙ্গলে পরিব্যাপ্ত জীবনরস। কাব্যটির আধার দেবী চণ্ডিকে ঘিরে হলেও আধেয়
হচ্ছে সজীব বাঙ্গালীর গৃহ জীবন। জীবনকে নানা কোন থেকে দেখা, জীবনের উষ্ণতা কে উপলব্ধি
করা, রূঢ় বাস্তবতার স্বরূপ উদঘাটন করা সমস্ত ক্ষেত্রেই তিনি মধ্যযুগের কবি হয়েও স্বতন্ত্র।
আখ্যায়িকা উপস্থাপনে ঘটনা বর্ণনার অভিনবত্বে তিনি কখনো উপন্যাসিকের মত কখনো বা নাট্যকার
সুলভ। ঔপন্যাসিক এর বাস্তবতা প্রীতি পর্যবেক্ষণ কুশলতা অভিজ্ঞতা পরায়ণতা মনস্তত্ত্ব
বৈশিষ্ট্যগুলি তার কাব্যে দেখা যায়।
২) চন্ডীমঙ্গলের আদি কবি কে? তার কি পরিচয় পাওয়া যায়?
মধ্যযুগের বাংলা
সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার চন্ডীমঙ্গলের আদি কবি মানিক দত্ত।
মনসামঙ্গলের আদি কবি কানা হরিদত্তের মতো মানিক
দত্তের পুঁথি দুষ্প্রাপ্য নয়। মানিক দত্তের
বেশ কয়েকটি পুঁথি পাওয়া গেছে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মানিক দত্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে
বলেছেন "যাহা হৈতে হৈল গীত পথ পরিচয় ।" দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেন মানিক
দত্ত ত্রয়োদশ শতাব্দীর কবি এছাড়া আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন তিনি ষোড়শ শতাব্দীর
কবি। মানিক দত্ত সম্পর্কে যেটুকু তথ্য জানা যায় তাতে জানা যায় তিনি মালদহ জেলার ফুলবাড়িয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন ।তার আত্মপরিচয় থেকে জানা
যায় তিনি ছেলেবেলায় বিকলাঙ্গ ছিলেন ,দেবী চণ্ডীর কৃপায় তিনি সুস্থ হন এবং কাব্যসাধনায়
মনোনিবেশ করেন। মানিক দত্ত চন্ডীমঙ্গল কাহিনীকে ব্রত কথার খোলস থেকে মঙ্গলকাব্যের আকার
দেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
৩) চন্ডীমঙ্গলের কবি দ্বিজমাধব বা মাধবাচার্যের পরিচয় দাও। তাঁর রচনারকাল নির্ধারণ করো।
চন্ডীমঙ্গল কাব্য ধারার প্রাচীনতম রূপকার হলেন
কবি মাধবাচার্য বা দ্বিজমাধব। তার কাব্যের নাম সারদামঙ্গল বা সারদাচরিত। চট্টগ্রামে
কাব্যটি জাগরণ নামেও পরিচিত। ড: সুধীভূষণ ভট্টাচার্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাব্যটি
মঙ্গলচন্ডীর গীত নামে সম্পাদনা করেন। কবির আত্মবিবরণী থেকে জানা যায় পশ্চিমবঙ্গের
সপ্তগ্রাম বা নবদ্বীপের কোন এক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতার নাম পরাশর।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত মঙ্গলচন্ডীরগীত
- পাওয়া যায় "ইন্দু বিন্দু বাণ ধাতা শক নিয়োজিত" এর থেকে অনুমান করা হয় কাব্যটি ১৫০১ শকাব্দ অর্থাৎ
১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়।
৪) দ্বিজমাধব এর কবি প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করো ।
দ্বিজমাধব ব্রতকথা ও পাঁচালীর আঙ্গিকে কাহিনী পরিবেশন করেছেন। তিনি ছিলেন
বস্তুনিষ্ঠ কবি ফলে রস সৃষ্টি অপেক্ষা তথ্য সংগ্রহে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আখ্যান
বর্ণনায় একটি সজীব প্রত্যক্ষতা ও আনুপূর্বিক অখন্ডতা দেখা যায়। তাই তার ভাষা অলংকার
বর্জিত ও নিতান্ত অনাড়ম্বর হলেও বর্ণনার বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ।
শুধু আখ্যান বর্ণনাতেই নয় চরিত্র সৃষ্টিতেও দ্বিজমাধব
বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কালকেতু, ফুল্লরা ,ভাড়ুদত্ত, মুরারীশীল চরিত্র-বৈশিষ্ট্য
অখন্ড সামগ্রিকতায় বিধৃত হয়েছে ।সভ্য মানব সমাজের কৃত্রিমতা তাদের মানসিকতাকে কলুষিত
করতে পারেনি। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হয় কবিকঙ্কন এর মত শৈল্পিক গুণের অধিকারী
তিনি ছিলেন না।
৫) মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর কাব্য কে নতুন মঙ্গল বলেছেন কেন?
মুকুন্দ চক্রবর্তী চন্ডীমঙ্গলের অন্যান্য কবিদের
মতো প্রচলিত কাহিনীকে গ্রহণ করেছেন তাই তার স্বকীয়তা কাহিনী সৃষ্টিতে নয় কাহিনীর
নবতর রূপ নির্মাণে। পুরাতন কাহিনী তার প্রতিভার স্পর্শে নতুন রূপ লাভ করেছে। কাহিনী
গ্রন্থনের মুনশিয়ানা, চরিত্র নির্মাণের দক্ষতা, উপস্থাপন বিন্যাস ,রচনা রীতির কৌশল,
জীবন সম্পর্কে ভাবগম্ভীর এবং বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি তার কাব্য কে অতি সহজেই অসাধারণত্বের
পর্যায়ে উন্নীত করেছে। শুধু সেকালের বাস্তব চিত্র অঙ্কন করে তিনি ক্ষান্ত হননি তার
সঙ্গে মানব জীবনের সুখ-দুঃখের সম্পর্ক স্থাপন করে বস্তুচিত্রকে রসাশ্রিত করে তুলেছেন।
মুকুন্দরাম সুখে-দুখে প্রাচুর্যে ও রিক্ততায় আলো আঁধারে জীবনের বৈচিত্র্য ও বিস্তার
কে উপন্যাসের সমগ্রতা দান করেছেন।
৬) মুকুন্দ চক্রবর্তী কে কি দুঃখবাদী কবি বলা যায়?
দীনেশচন্দ্র সেন মুকুন্দ
চক্রবর্তী সম্পর্কে বলেছেন- "কবিকঙ্কন সুখের কথায় বড় নহেন দুঃখের কথায় বড়।"
আপদে-বিপদে সুখে-দুখে বন্ধুর জীবন পথে নিত্যকালের বাঙালির জীবনযাত্রার আলেখ্য সৃষ্টি
করতে গিয়ে মুকুন্দ চক্রবর্তী দুঃখের চিত্র অঙ্কন করেছেন। আত্মবিবরনী ,দেবী চণ্ডীর কাছে অসহায় পশুদের অভিযো্
খুল্লনার বারমাস্যা ,ফুল্লরার বারোমাস্যা প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় কবি দুঃখময়
জীবনের ছবি অঙ্কন করেছেন, কিন্তু চরম সত্য
বলে মনে করেন নি কিংবা তার মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেন নি । বরং এর উপর তিনি দুঃখোতীর্ণ
জীবন রসসিক্ত আনন্দ শতদল কে ফুটিয়ে তুলে তার
সৌরভকে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। জীবনরস সম্ভোগে তিনি জীবনবাদী কবি, ভোগবাদী কবি,
তিনি জীবন রসিক কবি।