HEADER ADDS

ভাষা কাকে বলে ? ভাষা ও উপভাষার সম্পর্ক আলোচনা কর । বাংলা ভাষার উপভাষাগুলির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর ।

ভাষা কাকে বলে ? ভাষা ও উপভাষার সম্পর্ক আলোচনা কর । বাংলা ভাষার উপভাষাগুলির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর ।

ভাষা হল ভাবের বাহন । কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য যে বাক্‌-সংকেত ব্যবহার করে তাকে ভাষা বলে ।

এখন আমরা দেখে নিই বিভিন্ন ভাষাবিদ ভাষার সংজ্ঞা কীভাবে দিয়েছেন -

 

ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষা কাকে বলে এ সম্পর্কে বলেছেন -

মনের ভাব প্রকাশের জন্য, বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোন বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত, শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।”

 

সুকুমার সেন ভাষা  সম্পর্কে বলেছেন -

মানুষের উচ্চারিত বহুজনবোধ্য ধবনি সমষ্টিই ভাষা

 

আধুনিক জার্মান মনীষী হুমবোল্ট ভাষা কি এ সম্পর্কে বলেছেন -

 'মানুষের ভাষাই হল তার আত্মা এবং তার আত্মাই হল তার ভাষা'

 

  ভাষা একটি বৃহৎ অঞ্চলে ব্যবহৃত । ফলে বিভিন্ন সময় ভাষার মধ্যে স্থান বিশেষে বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায় । এই বৈচিত্রকে আমরা উপভাষা বলতে পারি । যে জনসমষ্টি একই ধরনের ধ্বনিসমষ্টির বিধিবদ্ধ রূপের দ্বারা নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করে, ভাষাবিজ্ঞানীরা তাকে একটি ভাষা সম্প্রদায় বলেন

 

 কোনো ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দলে বা অঞ্চল বিশেষে প্রচলিত ভাষা ছাঁদকে উপভাষা বলে।

 

একই ধরনের ধ্বনি সমষ্টি দিয়ে সব মানুষের কাজ চলে না । অর্থাৎ এক-একটি ভাষা এক-একটি জনসমষ্টির নিজস্ব প্রকাশ মাধ্যম । কিন্তু এটি একটি ভাষা-সম্প্রদায় যে ভাষার মাধ্যমে ভাব বিনিময় করে, সেই ভাষারও রূপ সর্বত্র সম্পূর্ণ একরকম নয় । যেমন পূর্ববঙ্গের ভাষার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের বা দক্ষিণবঙ্গের ভাষার পার্থক্য আছে , যদিও তারা একই ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ।  

 

     উপভাষা হল একটি ভাষার অন্তর্গত এমন বিশেষ বিশেষ রূপ যা একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত, যার সঙ্গে আদর্শ বা সাহিত্যিক ভাষার  ধ্বনিগত, রূপগত ও বিশেষ বাগ্‌ধারাগত পার্থক্য আছে । এই পার্থক্য এমন সুস্পষ্ট যে ওইসব বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের রূপগুলিকে স্বতন্ত্র বলে ধরা যাবে, অথচ পার্থক্য টা যেন এতবেশি না হয় যাতে আঞ্চলিক রূপগুলি এক একটি সম্পূর্ণ পৃথক ভাষা হয়ে ওঠে ।  

 

    অঞ্চলভেদে যেমন একই ভাষার মধ্যে অল্পস্বল্প পার্থক্য হয়, তেমনি একই ভাষাভাষী লোকেদের কথায় সামাজিক স্তরভেদের কারণেও অল্পবিস্তর পার্থক্য দেখা দিতে পারে । তাই একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত, একজন অধ্যাপক, একজন উকিল, একজন রাজনৈতিক নেতা, একজন শ্রমজীবি এবং একজন দাগী অপরাধীর ভাষার উচ্চারণে ও শব্দ ব্যবহারে বেশ পার্থক্য চোখে পড়ে । একই ভাষার  মধ্যে সামাজিক স্তরভেদের কারণে এই যে পার্থক্য একে সামাজিক উপভাষা বা সমাজভাষা(Social Dialect বা Sociolect) বলে ।

 

 বাংলা ভাষার  প্রধান পাঁচটি উপভাষা হল – ১) রাঢ়ী     ২) বঙ্গালী     ৩) বরেন্দ্রী    ৪) কামরূপী বা রাজবংশী ৫) ঝাড়খণ্ডী  

 

উপভাষা গুলির ভৌগোলিক সীমানা -

১) রাঢ়ী         (মধ্য পশ্চিমবঙ্গ )

 পশ্চিম রাঢ়ী -   বীরভূম, বর্ধমান, পূর্ব বাঁকুড়া           পূর্বরাঢ়ী-    কলকাতা, ২৪ পরগনা, নদীয়া, হাওড়া, হুগলী, মুর্শিদাবাদ।) 

২) বঙ্গালী   - ঢাকা, মৈমনসিং, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোর নোয়াখালী, চট্টোগ্রাম ।

৩) বরেন্দ্রী    মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা । 

৪) ঝাড়খন্ডী   মাভূম, সিংভুম, ধল্ভূম , দক্ষিণ পশ্চিম  বাঁকুড়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর । 

৫) কামরূপী বা রাজবংশী    জলপাইগুড়ি,কোচবিহার ,  রংপুর, উত্তর দিনাজপুর, কাছাড়, শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা   

 

১) রাঢ়ী উপভাষা

 

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য  

 

)  রাঢ়ি উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য—অ' স্থলে '' উচ্চারণ।

যেমন :হল > হলো। মত > মতো বড় > বড়ো। অতুল > ওতুল। অজিত > জিত।

 

২) রাঢ়ী উপভাষার আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য— 'অভিশ্রুতি।

যেমন: করিয়া > কইর‍্যা > করে,   চারি > চাই > চার, বহিন > বইন > বোন,

 

৩)  রাঢ়ী উপভাষায় শব্দের শেষের  অঘোষধ্বনি ঘোষ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়।

যেমন :  কাক > কাগ,  ছাত> ছাদ, উপকার > উবগার।

 

৪)  রাঢ়ী উপভাষায় নাসিক্যীভবন ও স্বতোনাসিকীভবনের প্রাধান্য দেখা যায়।

যেমন : পুস্তিকা > পুথিআ > পুথি- পুঁথি। সূচ > খুঁচ, পেচক > পেঁচা।

ইষ্টক > ইট- ইট। তেমনি--চাঁদ (< চন্দ্র)

 

৫)  রাঢ়ী উপভাষায় অনেকসময়ই ন>, > ন হয়।  যেমন: নৌকা > লৌকা, নয় > লয়, নড়া > লড়া ,  লংকা > নংকা, লুচি > নুচি , , লোহা > নুয়া (নোয়া), লেবু > নেবু,

 

৬) রাঢ়ী উপভাষায় স্বরসঙ্গতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । যেমন:    বিলাতি > বিলিতি। দেশি>দিশি)

 

৭)  রাঢ়ী উপভাষায় অনেক সময় '' কার লোপ পায়।    যেমন : তাহার > তার, কহি > কই, দহ >

 

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) কর্তৃকারকে বহুবচনে ‘গুলা’, ‘গুলি’-‘ছেলেগুলা’, ‘লোকগুলি’, অন্যকারকে ‘দের’-‘আমাদের’, ‘তোমাদের’ ।

 

২) কর্মকাকারকে এবং সম্প্রদান কারকে ‘কে’ । যেমন – ‘রামকে টাকা দিলাম’, ‘ভিখারিকে পয়সা দিলাম’ ।

 

৩) রাঢ়ি উপভাষায় অধিকরণে ‘তে’, ‘এ’ বিভক্তি হয় । যেমন -‘মেঝেতে বিছানা পাতো’, ‘ঘরে বসে দুনিয়া দেখনা’।

 

২) যৌগিক ক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবপহার হয় যেমন – ‘করিতে ছিল’ > ‘করছিল’

 

৩) ভবিষ্যত কালে উত্তম পুরুষে ‘ইব’ > ‘ব’, মধ্যম পুরুষে ‘ইবে’ > ‘বে’, ‘ইবেন’ > ‘বেন’ । যেমন – ‘আমি করব’ > ‘আমি করবো’, ‘তুমি করবে’, ‘আপনি করবেন’, ‘সে করবে’ । তীতকালে ‘লাম’, ‘লে’, ‘ল’ ।  যেমন – ‘আমি করলাম’ (> ‘করলুম’), ‘তুমি করলে’, ‘সে করলো’ ।   বর্তমান কালে ‘ই’, ‘অ’ এ ‘আমি করি’, ‘তুমি কর’, ‘আপনি করুন’, ‘সে করে’।

 

২) বঙ্গালী  উপভাষা

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) অপিনিহিতির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । যেমন – ‘করিয়া’ > ‘কইরা’, রাখিয়া > ‘রাইখ্যা’ ইত্যাদি ।

 

২)  ‘ও – কার কখনো কখনো  হয়ে যায় ‘উ’ । যেমন – ‘ভোর’ > ‘বুর’/‘বুড়’, ‘চোর’ > ‘সুর’/‘সুড়’, ‘লোক’ > ‘লুগ’/‘লুক’ ।

 

৩) শব্দের আদিস্থিত ‘এ’ উচ্চারিত হয় ‘এ্যা’, যেমন – ‘দেশ’ > ‘দ্যাশ’, ‘তেল’ > ‘ত্যাল’ ।

 

৪) ঘোষবৎ মহাপ্রাণ বর্ণ (ঘ, , , , ভ) হয়ে যায় (গ, , , , ব)।  যেমন- ‘ঘোড়া’ > ‘গুরা’, ‘ঝি’ > ‘জি’, ‘ধান’ > ‘দান’, ‘ভত’ > ‘ভাত’ ।

৫) ‘ড়’ > ‘র’ আবার ‘র’ > ‘ড়’ হয়ে যায় অনেক অঞ্চলে । যেমন – ‘বুড়া’ > ‘বুরা’, ‘আমরা’ > ‘আমড়া’, ‘গড়ের মাঠ’ > ‘গরের মাড’, ‘ট’, ‘ঠ’ > ‘ড’ ‘মাঠ’, ‘কেটা’ > ‘কেডা’ ।

 

৬) কোথাও নাসিক্যব্যঞ্জন লুপ্ত না হয়ে উচ্চারিত হয় । যেমন – ‘চন্দ্র’ > ‘চান্দ’

তবে নাসিক্যব্যঞ্জন চন্দ্রবিন্দু হলে তা বঙ্গালীতে লুপ্ত হয় । যেমন – ‘চাঁদ’ > ‘চাদ’, ‘ফাঁদ’ > ‘ফাদ’, ‘কাঁদা’ > ‘কাদা’, ‘কাঁটা’ > ‘কাটা’ ।

 

৭) বঙ্গালি উপভাষায় ‘চ’ > ‘ৎস’, ‘ছ’ > ‘শ’, ‘জ’ > ‘dz’, ‘ঝ’ > ‘z’ রূপে উচ্চারিত হয় ।

এবং ক, , , , ফ কিছুটা উষ্ণধ্বনি রূপে উচ্চারিত হয় । যেমন – ‘কাগজ’ > ‘খাগজ’, ‘কালী পূজা’(‘xali fuja’), ‘জানতে পারনা’ > ‘z আন্তি পারনা’, ‘বাসের শীটে বসেছি’ > ‘বাচের ছিডে বইসি’ ।

 

8) বঙ্গালী উপভাষায়  , , , -  হ রূপে উচ্চারিত হয় । আবার কখনও কখনও ‘হ’ ধ্বনি ‘অ’ হয়ে যায় ।, ‘সে’ > ‘হে’, ‘শেয়াল’ > ‘হেয়াল’, ‘শতায়ু হও’ > ‘হতায়ু হও’, , ‘শাক’ > ‘হাগ’, ‘সিম’ > ‘ছিম’ ।

 

৯) শব্দের আদি মধ্যে অবস্থিত  ‘হ’ ধ্বনি ‘অ’ হয়ে যায় যেমন – ‘হয়’ > ‘অয়’ , হাতি’ > ‘আতি’

 

 

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) বঙ্গালি উপভাষায় কর্তৃকারকে ‘এ’ বিভক্তি হয়  যেমন - ‘মায়ে ডাকে’, ‘বাপে খেদাইসে’ ।

 

২) বঙ্গালি উপভাষায় গৌণকর্ম  সম্প্রদান কারকে ‘রে’ বিভক্তি হয়  যেমন – হালার পোলারে কইমু কী ? , আমারে খাইতে দিবা না ।  

 

৩) বঙ্গালি উপভাষায় করণকারকে ‘এ’ বিভক্তি ছাড়াও ‘সাথে’, ‘লগে’ ব্যবহার হয় । যেমন- ‘তার লগে যামুনা’।

 

৪) বঙ্গালি উপভাষায় অধিকরণ কারকে ‘ত’ বিভক্তি হয় । তবে কখনো কখনো ‘এ’ , ‘তে’ বিভক্তি যুক্ত হয় । যেমন- ঘরত যাউম ।

 

৫) অতীতকালে উত্তম পুরুষে ‘লাম’ –‘আমি আইলাম’

 

৬) সাধারণত ভবিষ্যতে মধ্যম পুরুষ ‘বা’ (‘তুমি জাবা’), উত্তম পুরুষ ‘উম’, ‘মু’(‘আমি খেলুম না = ‘আমি খেলবো না’), ‘আমি জামু’।

 

৭) বঙ্গালীতে অনেকসময় মূল ক্রিয়ার পর অসমাপিকা ক্রিয়া বসে । যেমন – সে চলে গেছে । বঙ্গালীতে ‘সে গ্যাসে গিয়া (‘চলে গেছে’ প্রয়োগও আছে)।

 

৩) বরেন্দ্রী  উপভাষার বৈশিষ্ট্য

 

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

 

১) ব্যঞ্জন ধ্বনির মূল উচ্চারণ বজায় আছে, তবে এ স্বরধ্বনি কখনো কখনো ‘অ্যা’ রূপে উচ্চারিত হয় ।

যেমন – ‘এক’ > ‘অ্যাক’, ‘দেন’ > ‘দ্যান’ ।

২) রাঢ়ীর মতো অনুনাসিক শব্দ উচ্চারণ আছে । যেমন – ‘কন্টক’ > ‘কাটা’, ‘চাঁদ’, ‘ফাদ’-বঙ্গালী লোকভাষায় এটি নেই ।

রাঢ়ীর শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত থাকে, বরেন্দ্রীতে নির্দিষ্ট্ শ্বাসাঘাত নেই ।

৩) পদান্তে মহাপ্রাণ অ ঘোষধ্বনি মৃদুতা পেয়েছে এবং ‘হ’ ধ্বনিও অত্যন্ত কোমলভাবে উচ্চারিত হয় বলেই একটা সুরের আবেশ সৃষ্টি হয় ।

আ’ > ‘রা’, ‘রা’ > ‘আ’ এবং ‘র’ ধ্বনির আগমও হয় । যেমন – ‘রাম বাবুর আম বাগান’ > ‘আমবাবুর রাম বাগান’, ‘রাজা’ > ‘আজা’, ‘রাগ’ > ‘আগ’, ‘রান্না’ > ‘আন্না’, ‘ইন্দুর’ > ‘রান্দুর’ ।

৪) ‘চ’ বর্গের তালব্য উচ্চারণ হয় । কিন্তু ‘জ’ অনেকসময় ‘উষ্ণ’-ইংরাজি ‘z’-এর মতো উচ্চারিত হয় । যেমন – ‘পূজা’ > ‘পূজা’

শ’, ‘ষ’, ‘স’ > ‘শ’ উচ্চারিত হয় । যেমন – ‘শম্পদ’, ‘শাহশ’, ‘শাগর’ ।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

 

১) বহূবচনে বিভক্তিতে ‘গুলা’ থাকলেও ‘গিলা’(‘গাছগিলা’), তির্যক কারকের বহূবচনে ‘দের’, গৌণ কর্মে ‘কে’, ‘ক’ (‘আমাকে দাও’)। অধিকরণ কারকে ‘ৎ’ যেমন – ‘ঘরৎ আইলনা’।

২) উত্তম পুরুষের ভবিষ্যৎকালে ‘ম’, ‘মু’, অতীত কালের উত্তমপুরুষে ‘লাম’ । যেমন – ‘বাড়িৎ যামু’, ‘আইতামনা’, ‘করলাম না’।

৪) ঝাড়খন্ডী উপভাষা

 

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) ঝাড়খণ্ডী উপভাষায় শব্দের ‘অ’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবিকৃত থাকে বরং অ এবং ও উচ্চারিত হয় বিবৃত ‘অ’ রূপে ।

যেমন – ‘লোক’ > ‘লক’, ‘চোর’ > ‘চর’, ‘মোটা’ > ‘মটা’, ‘তোর’ > ‘তর’, ‘বোকা’ > ‘বকা’ ।

 

২) ঝাড়খণ্ডী উপভাষায় সানুনাসিক স্বরধনির  উচ্চারণ অতিরিক্ত বেশি । যেমন – ‘হাতে’ > ‘হাঁতে, ‘মাঠে’ > ‘মাঁঠে’, ‘পেয়েছে’ > ‘পাঁইছে’, ‘হয়েছে’ > ‘হঁইছে’ ।

৩) অপিনিহিতি কিছুটা দূর্বলভাবে উচ্চারিত হয় ।

যেমন – ‘কাল’ > ‘কাইল’, ‘সত্য’ > ‘সইত্ত’, ‘বাইক্য’ > ‘বাইক্ক’, ‘রাইকখস’ > ‘রাইকখস’ ।

৪) অল্পপ্রাণ মহাপ্রাণ ধ্বনিতে পরিণত হয় ।

যেমন – ‘দূর’ > ‘ধূর’, ‘শাক’ > ‘শাগ’, ‘তোকে’ > ‘তোখে’ । 

৫) স্বরসংগতি প্রায়শই ব্যবহার হয়না ।

যেমন – ‘শিয়াল’, ‘আস্যেছে’ > ‘এসেছে’, ‘দেশি’ ।      

৬) ‘ন’ > ‘ল’ ধ্বনিতে পরিণত হয় । যেমন – ‘নাতি’ > ‘লাতি’, ‘নয়’ > ‘লয়’, ‘নদী’ > ‘লদী’ ।

 

 

রূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

 

১) ঝাড়খণ্ডী উপভাষায়  গৌণকর্মে সম্প্রদানে ‘কে’ বিভক্তি ।

যেমন – ‘আমরাকে দিঠে(দিচ্ছে) নাই’, ‘তোমরাকে ডাইকেছে’, । নিমিত্তে রাঢ়ীর মতই ‘কে’ । যেমন – ‘কাঠ আইনতে বনকে গেঁইঠে ‘, ‘জলকে চল’ ।

২) স্বার্থিক ‘ক’ প্রত্যয়ের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় ।   যেমন – ‘খাবেক, ‘হবেক’, ‘যাবেক’ ।

৩) ওড়িয়া ভাষার প্রভাবে বহুবচনে ‘মন’ বা ‘মেন’ যুক্ত হয় ।    যেমন – ‘তাদের’ > ‘তারমনকার’ ।

৪) অতীতকালে উত্তরপুরুষে ‘ই’ বিভক্তি । যেমন – ‘আমি যাতেছিলি’ ।

৫) নাম ধাতুর অতিরিক্ত ব্যবহার । যেমন – ‘পখহরের জলটা গঁধাচ্ছে’ রাতে জাড়াচ্ছে’।

৬) ‘বট’ ধাতুর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়  । যেমন – ‘মিছা বটে’, ‘কথাটা বলললি বটে’ ।

৭) যৌগিক প্রযোজক ক্রিয়ার ব্যবহার । যেমন – ‘কতজনা আছে গুনা করাও’, ‘সব আনা করানো আছে’ ।            

 

 ৫) কামরূপী  উপভাষা

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

 

১) , , , , ভ ধ্বনিগুলির মহাপ্রাণতা শুধু শব্দের আদিতে থাকে । যেমন – ‘ঘর’, ‘ধান’, ‘ভয়’, ‘ঝগরা’, ‘ঢোল’, কিন্তু শব্দের শেষে দেখা যায় ‘বাঘ’ > ‘বাগ’, ‘সমঝান’ > ‘সমজান’, ‘বাধা’ > ‘বাদা’, ‘সভা’ > ‘সবা’ ।

 

২) বঙ্গালীর মতোই ‘ড়’ > ‘র’, এবং ‘র’ > ‘ড়’ । যেমন – ‘বাড়ি’ > ‘বারি’, ‘হাড়’ > ‘হার’, ‘কাছাড়’ > ‘কাচার’ ।

 

৩) , , স বঙ্গালীর মতোই ‘হ’ ধ্বনিতে পরিণত হয় । যেমন – ‘সবাই’ > ‘হবাই’, ‘শেষ’ > ‘হ্যাজ’ ।

 

৪) পদের আদিতে ‘র’ অনেকসময় ‘অ’ হয়ে যায় । যেমন – ‘রস’ > ‘অস’, ‘রঙ’ > ‘অং’, ‘রাতি’ > ‘আতি’ ।

 

৫) রাঢ়ী ও ঝাড়খন্ডী লোকভাষার মতো ‘ল’ > ‘ন’, ‘ন’ > ‘ল’ ।  যেমন – ‘লাউ’ > ‘নাউ’, ‘লাঙ্গল’ > ‘নাঙ্গল’, ‘সিনান’ > ‘হিলাল’ ।

 

৬) শ্বাসাঘাতের ফলে ‘অ’ থেকে ‘আ’ হয় রাঢ়ীর মতোই । যেমন- ‘অসুখ’ > ‘আসুখ’, ‘অতি’ > ‘আতি’, ‘অমাবস্যা’ > ‘আমাবস্যা’ । এটি হিন্দি বা অন্যান্য নব্য ভারতীয় আর্যর ধারাও হতে পারে । যেমন – ‘ধনবাদ’ > ‘ধানবাদ’ ।

 

৭) ‘ও’ কখনও ‘উ’ হয়ে যায় । এটি পশ্চিম রাঢ়ী, ঝাড়খন্ডী ও াঙ্গালীতেও দেখা যায় । যেমন – ‘কোথা’ > ‘কুথা’, ‘তোমার’ > ‘তুমার’ ।

 

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১) বরেন্দ্রীর মতোই অধিকরণে ‘ৎ’ বিভক্তি । যেমন – ‘পশ্চাতে’ > ‘পাছৎ’, ‘বাড়িতে’ > ‘বারিৎ’ ।

সম্বন্ধ পদে ‘র’ ‘ক’ । যেমন – ‘বাপের’ > ‘বাপক’, ‘ছাগলর’ ।

গৌণ কর্মের বিভক্তি হল ‘ক’ । যেমন – ‘আমাকে’ > ‘হামাক’, ‘মোক দিয়া যাও’ ।

 

২) নঞর্থক ক্রিয়ার গঠনে ‘না’ বাচক অব্যয় শব্দের পূর্বে যুক্ত হয় । যেমন – ‘না লেখিম’, ‘না জাওঁ’, সামান্য অতীতে উত্তম পুরুষে ‘নু’, প্রথম পুরুষে ‘ইল’ । যেমন – ‘আমি করনু’, ‘সে কহিল’ ।

তির্যক কারকের বহুবচনে প্রত্যয় হল ‘গুলা’, যেমন- ‘আমার গুলার’ ।

 

৩) অসমাপিকার ক্রিয়ার প্রত্যয় ‘ই’, যেমন – ‘করিয়া’ > ‘করি’, ‘রাখিয়া’ > ‘রাখি’ ইত্যাদি ।

‘-ল’/‘-ব’ যুক্ত করে কৃদন্ত বিশেষণ তৈরি করা হয় । যেমন – ‘দেখা মানুষ’ > ‘দেখিলা মানশি’, ‘আগামি দিন’ > ‘আশিবা দিন’ ।