ব্যাকরণ কাকে বলে ? ব্যকরণ পাঠের উদ্দেশ্য , বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস
ব্যাকরণ কী
এবং কেন ?
‘ব্যাকরণ’ কথাটির অর্থ হল :
[বি + আকরণ] : বিশেষভাবে উচ্চারিত বা লিখিত মাতৃভাষার
শুদ্ধি ও অশুদ্ধি বিচার করে শ্রেণি-বিন্যাস। তাছাড়া, তা অশুদ্ধি
সংশোধন করে ভাষার শুদ্ধ রূপের প্রয়োগের করে
পথ-নির্দেশ। ‘ব্যাকরণ’ শব্দটি সংস্কৃত থেকেগৃহীত।
অর্থ : ‘ব্যাক্রিয়ন্তে ব্যুৎপাদ্যন্তে শব্দা অনেন
ব্যাকরণম্’—‘ব্যুৎপত্তি অর্থাৎ শব্দের উৎসগত রূপসহ
তার গঠন যা ব্যক্ত করে, তাই ব্যাকরণ। কিন্তু বাংলায়
‘ব্যাকরণ’ শব্দ
অর্থ শব্দের উৎসগত রূপসহ তার গঠন ছাড়া আরো বহু-ব্যাপক। এমনকি, ইংরেজি ‘Grammar’
যা হল কিনা “art of speaking and writing a language correctly” কিন্তু
‘ব্যাকরণ’ শব্দটি বর্তমানে শব্দ বিশ্লেষণের এই সংক্ষিপ্ত অর্থে
সীমাবদ্ধ নেই,
বিস্তীর্ণ অর্থে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ভাষা বিষয়ক শাস্ত্র’ বা ‘বিদ্যা’।
অর্থাৎ যে শাস্ত্র বা বিদ্যার সাহায্যে কোনো ভাষার নিয়ম-কানুন বিশ্লেষণ করে তার
স্বরূপ, গঠন
ও প্রয়োগরীতিকে সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া যায় এবং যার সাহায্যে
সেই ভাষাকে শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে বলতে, পড়তে ও লিখতে পারা যায়, তাকে
ব্যাকরণ বলে।
বাংলা ব্যাকরণের সংজ্ঞা-
১) সুনীতিকুমার
চট্টোপাধ্যায়: যে বিদ্যার দ্বারা কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া তাহার স্বরূপটি
আলোচিত হয় এবং ভাষার পঠনে ও লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শদ্ধরূপে তাহার প্রয়োগ
করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।
২) ড.
সুকুমার সেন : কোন ভাষার উপাদান সমগ্রভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ যে বিদ্যার বিষয় তাহাকে
সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে। বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতির বিচার ও
বিশ্লেষণ এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে বলতে, লিখতে ও শিখতে পারা যায় তাকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ সংক্ষেপে
বাংলা ব্যাকরণ বলে।
৩) ড.
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : যে শাস্ত্র জানিলে বাঙ্গালা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায়, তাহার
নাম বাঙ্গালা ব্যাকরণ।
৪) মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী: যে শাস্ত্রে কোনো ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতির স্বরূপের বিচার বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয়,তাকে ব্যাকরণ বলে।
৫) ড.
মুহম্মদ এনামুল হক : যে শাস্ত্রের দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া ইহার বিবিধ অংশের
পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায় এবং ভাষা রচনাকালে আবশ্যক মত সেই নির্ণীত
তত্ত্ব ও তথ্য প্রয়োগ সম্ভবপর হইয়া উঠে, তাহার
নাম ব্যাকরণ।
জ্যোতিভূষণ
চাকী: যে ব্যাকরণ বাংলাভাষার ধ্বনি, শব্দ, পদ ও বাক্য ইত্যাদির বিশ্লেষণ করে ভাষার স্বরূপটিকে তুলে
ধরে তাকেই আমরা বাংলা ব্যাকরণ বলতে পারি।
তাই আমরা বলতে
পারি - যে শাস্ত্র বা বিদ্যার সাহায্যে মান্য বাংলা ভাষার রূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানলাভ করা
যায় এবং যার সাহায্যে বাংলা ভাষাকে শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে বলতে, পড়তে
ও লিখতে পারা যায়, তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
বাংলা ব্যাকরণের বিষয়বস্তু
পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার
ব্যাকরণের চারটি মৌলিক অংশ থাকে। যথা—ধ্বনি, শব্দ, বাক্য
ও অর্থ। এই দিক থেকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণের বিষয়বস্তুর প্রধান চারটি ভাগ। যথা—
(ক) ধ্বনিতত্ত্ব
(Phonology)
: ধ্বনিতত্ত্বে ভাষায় উচ্চারিত ধ্বনিসমূহের পরিচয়, ধ্বনি
পরিবর্তনের কারণ ও ধারা, বানান বিধি (ণত্ব ও ষত্ব-বিধান), সন্ধি আলোচিত হয় ।
(খ) রূপতত্ত্ব
(morphology) : রূপতত্ত্বে শব্দ
প্রকরণ ও পদ গঠনের
বিভিন্ন রূপ তথা বিভক্তি, উপসর্গ, অনুসর্গ, প্রত্যয়, সমাস, কারক
ইত্যাদির আলোচনা করা হয় ।
(গ) বাক্যতত্ত্ব
(Syntax)
: বাক্যের উপাদান, গঠন, বিশ্লেষণ, শ্রেণিবিভাগ, রূপান্তর, বাচ্যের
গঠন, বিশ্লেষণ, শ্রেণিবিভাগ
ইত্যাদি বিষয় বাক্যতত্ত্বে
আলোচিত হয়।
(ঘ) শব্দার্থতত্ত্ব
(Semantics)
: এই
পর্বে শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণ ও ধারা, শব্দার্থের
প্রকারভেদ,
সমার্থক শব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ, সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ, বাগধারা,
প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদির বিস্তৃত আলোচনা প্রাধান্য পায় ।
ব্যাকরণের
প্রকরণ
বিভিব্ব বৈশিষ্ট্যের
উপর নির্ভর করে ব্যাকরণকে চার ভাগে বিভক্ত ভাগ করা হয় -।
১. বর্ণনাত্মক
ব্যাকরণ: এ জাতীয় ব্যাকরণে সাধারণত বিশেষ কোন কালে বা যুগে, কোন
একটি ভাষার রীতি ও
প্রয়োগ ইত্যাদি বর্ণনা করা এ ধরনের ব্যাকরণের বিষয়বস্তু এবং সেই বিশেষ কালের
ভাষা যথাযথ ব্যবহার
করতে
সাহায্য করাই এই ব্যাকরণের উদ্দেশ্য।
২. ঐতিহাসিক
ব্যাকরণ: কোন একটি ভাষার উৎপত্তি থেকে চলমান সময় বা বর্তমান কাল পর্যন্ত সে
ভাষার ক্রমবিকাশের
ইতিহাস পর্যালোচনা করা এই ব্যাকরণের আসল লক্ষ্য।
৩. তুলনামূলক
ব্যাকরণ: এই শ্রেণির ব্যাকরণ কোন বিশেষ সময়ের বিভিন্ন ভাষার গঠন, প্রয়োগরীতির তুলনামূলক
আলোচনা করে থাকে তাকেই তুলনামূলক ব্যাকরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪. দার্শনিক-বিচারমূলক
ব্যাকরণ: ভাষার অন্তর্নিহিত চিন্তাপ্রণালি আবিষ্কার ও অবলম্বন করে সাধারণভাবে অথবা
বিশেষভাবে ভাষারূপের উৎপত্তির বিবর্তন কিভাবে ঘটে তার বিচার করাই এই ব্যাকরণের মূল উদ্দেশ্য।
বাংলা ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা
মনুষ্যের ভাষা বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাইবে,ভাশার গঠন প্রণালীতে কতকগুলি নিয়ম আছে । শব্দের গঠনে , পদের গঠনে , ও বাক্যের গঠনে এইরূপ নিয়মের আবিষ্কারই ব্যাকরণের ( অর্থাৎ গ্রামারের ) উদ্দেশ্য । - রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী
ব্যাকরণ হলো
ভাষার সংবিধান। কোনো ভাষাকে
শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে লেখা, পড়া বা বলার জন্য সেই ভাষার ব্যাকরণ
পাঠ একান্ত
আবশ্যক।
বাংলা ভাষার এই অভিন্ন
লেখ্য ও মান্যরূপের স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে এবং তাকে
শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে পড়তে, লিখতে ও বলতে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ পাঠ একান্ত
প্রয়োজন। বাংলা ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা নিম্নে পৃথক-পৃথক করে দেখানো
যেতে পারে—
১. ভাষার গঠন, স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাকরণ পাঠে ধারণা লাভ করা যায় ।
২. ভাষার
শুদ্ধ-অশুদ্ধ বিষয় জানার জন্য ব্যাকরণ-জ্ঞান প্রয়োজন ।
৩. ব্যাকরণ পাঠ করে ভাষা
ব্যবহারের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত থাকা যায় ।
৪. ব্যাকরণ পাঠ করলে ভাষা শুদ্ধ
রূপে ব্যবহার করা যায় ।
৫. ভাষায় ব্যবহৃত
প্রবাদ-প্রবচন ও বাগধারা সম্পর্কে ধারণা লাভ করার জন্য ব্যাকরণ পাঠ প্রয়োজন।
৬. ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস
ব্যাকরণ পাঠ করে জানা যায় ।
৭. ভাষার প্রকৃত সৌন্দর্য
উপলব্ধির জন্য ব্যাকরণ পাঠ করা প্রয়োজন।
৮. ব্যাকরণ পাঠ করলে ভাষার প্রকৃত
আদর্শ রক্ষা করা যায়।
৯. ব্যাকরণ ভাষাজ্ঞানকে
নান্দনিক করে।
১০. সাহিত্যের যথার্থ রস
আস্বাদনের জন্যও ব্যাকরণ পাঠ করা প্রয়োজন ।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ইতিহাস
ব্যাকরণ
শব্দটির উৎস কৃষ্ণযজুর্বেদে। শিক্ষা ও বৈদিক প্রাতিশাখ্যকে অবলম্বন করে
বিবর্তিত হয়েছিল পরবর্তী ব্যাকরণ, যার মধ্যে
পাণিনির স্থান ছিল বিশিষ্ট । কাত্যায়ন ছিলেন পাণিনির দোষদর্শী, পতঞ্জলি
ছিলেন সমর্থক। পাণিনির মূল রচনা এই দুজনের সংশোধন ও সংযোজনের মধ্যে দিয়ে
পূর্ণতা লাভ করেছিল। এই তিনজনকেতাই বলা হয় ত্রিমুনি। কাত্যায়ন বার্তিক রচনা করেন, পরিবর্তনগুলিকে
ধরবার জন্যে।
পাণিনির বেশ কিছু সূত্র কাত্যায়ন নিষ্প্রয়োজন মনে করে বর্জন করেছিলেন। কাত্যায়নের
বেশ কিছু পরে আমরা পেয়েছি বৈয়াকরণ পতঞ্জলিকে। তিনি মহাভাষ্য রচনা করেন।
এটি পাণিনি ব্যাকরণেরই ভাষ্য । পতঞ্জলি কাত্যায়নের পরিত্যক্ত কিছু
পাণিনিসূত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ব্যাকরণেও যে রসসৃষ্টি করা যায় তা
দেখিয়েছেন পতঞ্জলি। এর পর দীর্ঘদিন ব্যাকরণচর্চার ক্ষেত্রে কোনও মৌলিক
অবদান দেখা যায়নি। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ভর্তৃহরি পদ্যবন্ধে ‘বাক্যপদীয়' রচনা
করেন, এতে
বাক্যগঠনের বহু তত্ত্ব সূক্ষ্মভাবে আলোচিত হয়েছে, যদিও
দার্শনিক তত্ত্বের উপরেই তার প্রতিষ্ঠা। ব্যাকরণচর্চায় বৌদ্ধ ও জৈন
বৈয়াকরণদের অবদানও স্বীকৃতির দাবি রাখে। পরবর্তী কালে (সপ্তদশ শতকে)
পাণিনি-চর্চায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভট্টোজি দীক্ষিতের
সিদ্ধান্তকৌমুদী। তাঁর পুত্র ও তিনি নিজে ‘সিদ্ধান্তকৌমুদী'র
দুটি টীকা রচনা করেন— -বালমনোরমা ও প্রৌঢ়মনোরমা। পাণিনি-ধারা
ছাড়াও ঐন্দ্র,
চান্দ্র,
জৈনেন্দ্রীয়, শাকটায়নী, হেমচন্দ্রীয়, কাতন্ত্র, সারন্বত, মুগ্ধবোধ, জৌমর, সৌপদ্ম, কালাপিক
ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাকরণের ধারা প্রচলিত ছিল। এই সব ব্যাকরণধারার
মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও শব্দসাধন ব্যাপারে কিছু কিছু
পার্থক্য ছিল। বঙ্গদেশে মুগ্ধবোধ ও কলাপব্যাকরণ সমধিক প্রচলিত থাকলেও
পুরুষোত্তমদেবের ভাষাবৃত্তি, সীরদেবের পরিভাষাবৃত্তি এবং শরণদেবের
দুর্ঘটবৃত্তি এখানে পাণিনিচর্চার সাক্ষ্য বহন করে । রচনা এবং ভট্টোজি
দীক্ষিতের সিদ্ধান্তকৌমুদীকে সহজ সংক্ষিপ্ত করে রচিত হয়েছিল লঘুকৌমুদী।
এই লঘুকৌমুদীও বাংলায় প্রচলিত ছিল। সিদ্ধান্তকৌমুদী ও মুগ্ধবোধাদি
ব্যাকরণের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যাকরণকৌমুদী করেন । এতে
বাংলা ব্যাখ্যা সংযোজিত হওয়ায়শব্দরূপ-ধাতুরূপাদির সহজ বিন্যাস থাকায়
ব্যাকরণচর্চা সহজ
বাংলা ব্যাকরণকারেরাও সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মগুলি ভালভাবে জানবার সুযোগ পান ।
শব্দরূপ ও ক্রিয়ারূপের বিন্যাস, সন্ধি, সমাস, ধাতুর
গণবিভাগ ইত্যাদি
বহু বিষয়ে বাংলা ব্যাকরণ বিদ্যাসাগরের এই ব্যাকরণকৌমুদীর কাছে ঋণী । ইয়োরোপীয়
পণ্ডিত ও ভাষাতাত্ত্বিকেরাই প্রথমে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন।
সর্বপ্রথম পোর্তুগিজ ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন মনোএল দা
আস্সুম্পসাঁও (১৭৪৩)। তার পর নাথেনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড ইংরেজি ভাষায়
বাংলা ব্যাকরণ লেখেন (১৭৭৮)। উইলিয়ম কেরি প্রমুখ শ্রীরামপুরের
আরও কয়েকজন বাংলা ভাষা রচনা করেন । রামমোহন রায় প্রথমে ইংরেজিতেই পরে তাঁর
বাংলায় লেখা গৌড়ীয় CONG শিখতেই বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন
১৮২৬ সালে ;
সালে। বাংলাভাষার
স্বরূপটি ধরবার উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা হয় এই ব্যাকরণে। বাঙালির ব্যাকরণ
প্রকাশিত হয় ১৮৩৩
লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ হিসেবে রামমোহন রায় রচিত ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণই স্বীকৃত ।
কিন্তু Leyden
সাহেবের সংগ্রহে অল্পপরিসরে যে বাংলা ব্যাকরণটি পাওয়া
গিয়েছে (লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত) তা ১৯৭০ সালে লন্ডন
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত
হয়েছে। যুক্তিপরম্পরায় তিনি মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালফারের ১৮০৭-১১
সালের মধ্যে লেখা বলে সিদ্ধান্তে এসেছেন। এই তথ্য স্বীকার করলে এই
ব্যাকরণটিকে গৌড়ীয় বাংলা ব্যাকরণের ২৬-২৭ বছর আগে লেখা বাঙালির
সর্বপ্রাচীন বাংলা ব্যাকরণ বলা যায়। এই ব্যাকরণটি গৌড়ীয় ব্যাকরণের
মতো পরিণত না হলেও বাংলা ভাষায় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য এতে নির্দেশিত
হয়েছে। এই
বইটি বহু গৌড়ীয়
বাংলা ব্যাকরণের পরে যাঁরা বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য ব্রজকিশোর গুপ্ত, শ্যামাচরণ শর্মা, শ্যামাচরণ
সরকার,দোহারাম
শিরোরত্ন,
রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও মদনমোহন মিত্র প্রমুখ বিদ্বজ্জন। আধুনিক যুগে
বাংলায় ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। পাশ্চাত্য ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে শিক্ষালাভ করে তিনি
বাংলা ভাষার উদ্ভব এবং ক্রমবিকাশ বিষয়ে গবেষণা করে ডি-লিট লাভ করেন
১৯২১ সালে। এই গবেষণা-নিবন্ধটি পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়ে
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে The Origin and Development of the Bengali Language নামে
প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। এই গ্রন্থে অন্যান্য ভাষার
ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্যে বাংলা ভাষাকে স্থাপন করে তিনি যেভাবে এর সবাঙ্গীণ
বিশ্লেষণ করেছেন তা শুধু নব্যভারতীয় ভাষা নয়, পৃথিবীর যে-কোনও
ভাষা বিশ্লেষণে অনুকরণীয়। এর পর ভাষাতত্ত্ববিষয়ক অন্যান্য অনেক গ্রন্থ
তিনি রচনা করেন। এই সময়ে ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে কয়েকটি গ্রন্থ
রচনা করেন। তাঁর রচিত বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। সুনীতিকুমার
চট্টোপাধ্যায়ের ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে।
বাংলা ভালায় ব্যাকরণের ইতিহাসে এই গ্রন্থটির একটি বিশেষ স্থান আছে।
ভাষা প্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ বহু বিষয়েই অনন্য। সাধু-চলিত দুই ভাষারই সূক্ষ্ম
বিশ্লেষণে বাংলা ভাষায় স্বরূপের এত কাছে এর আগে আর কেউ আসেননি। ODBL-এ
বা 'বাংলা
ভাষাতত্ত্বের
ভূমিকা'য়
তিনি ধ্বনি পরিবর্তনের যে সব ধারা ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোকে লক্ষ করেছেন তা
তিনি এই ব্যাকরণে উপস্থাপিত করেছেন, ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনাতেও
এর আগে এমন গভীরে কেউ যাননি। অর্থ পরিবর্তনের ধারা ও বাংলা
ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার তুলনাত্মক পর্যায়টি তিনি পরিশিষ্টে রেখেছেন ।· পূর্ণত
প্রথাবিরোধী হয়তো হতে চাননি। এই ফায়ে প্রচলিত নকুলেশ্বর
বিদ্যাভূষণের ব্যাকরণটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আচার্য সুর্নীতিকুমার
বলেছেন ‘রামমোহন আর নকুলেশ্বর, বিদ্যাভূষণ ছাড়া আর কেউ বাংলা ভাষার
ভিতরকার প্রকৃতি ধরতে পারেননি, বা সেদিকে নজর দেননি ।' (মনীষী-স্মরলেপ
৫৪)।* ডঃ সুকুমার সেনও বাংলা ভাষাবিষয়ক বহু গবেষণা গ্রন্থের
সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। অধ্যাপক শ্যামাপদ চক্রবর্তী
বাংলা ব্যাকরণও একটি বিশিষ্ট অবদান। এগুলি সবই স্কুলপাঠ্য হিসেবে
নির্দিষ্ট -পাঠক্রমের ভিত্তিতে রচিত। বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত যে ধারা
চলেছে তা সুনীতিকুমারের ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ এরই হেরফের। সময় এসেছে
সর্বসাধারণের জন্যে একটি বাংলা ব্যাকরণ রচনার, যে ব্যাকরণ বাংলা ভাষার
স্বরূপটিকে চিনিয়ে দেবে, এবং নতুন গবেষণার প্রেরণা দেবে। বাংলা
ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। বাংলা ভাষার বেশ কিছু
বৈশিষ্ট্য বা ইঙ্গিতকে তুলে ধরে বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে তিনি বিজ্ঞানসম্মত
গবেষণার পথ দেখিয়েছিলেন। খাঁটি বাংলা ব্যাকরণের দিক্-নির্দেশে
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মহাশয়ের লেখাগুলিও বিশেষ
গুরুত্বপূর্ণ ।
স্থূলপাঠ্য হিসেবে রচিত সাম্প্রতিক বাংলা ব্যাকরণগুলিতে কিছু কিছু নূতন চিন্তাভাবনার
পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশে পূর্ণাঙ্গ বাংলা ব্যাকরণ রচিত না হলেও বাংলা
ব্যাকরণের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা চলছে। সুনীতিকুমার বা সুকুমার সেন
নব্যভাষাতত্ত্বের উপর কোনও আলোকপাত করেননি, তাঁদের
ভাষাচর্চার ক্ষেত্রও ছিল অন্য। তবে সুনীতিকুমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নব্য ভাষাচিন্তা বিষয়ক গ্রন্থ ভাষাতত্ত্ব এর ভূমিকা লিখে
(২০শে ডিসেম্বর ১৯৭৪) ওঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভূমিকার প্রথম দিকে
বলেছেন : 'অধ্যাপক
রফিকুল ইসলামের
নাতিদীর্ঘ পুস্তক 'ভাষাতত্ত্ব: পাঠ করিয়া বিশেষ
আনন্দলাভ করিয়াছি—আমার অনালোচিত কোনও কোনও বিষয়ে নূতন আলোক পাইয়াছি।'
আমাদের এখানেও সঞ্জননী ব্যাকরণচর্চার সূত্রপাত হয় ৭০-এর দশকে। এ বিষয়ে প্রথম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অধ্যাপক পবিত্র সরকার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত একটি ভাষাবিষয়ক সেমিনারে। তারপর থেকেই তিনি নব্য ভাষাচিন্তা বিষয়ে পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে চলেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রভারতী পত্রিকার হ্যালহেড-সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর সংবর্তনী-সঞ্জননী ভাষাতত্ত্ব ও বাংলা ভাষাবিচার প্রবন্ধটি। তিনি মনে করেন সঞ্জননী ধ্বনিবিজ্ঞান বাংলার বহু উচ্চারণ ও ধ্বনি বিশ্লেষণে নূতন পথ দেখাতে পারবে। বাংলায় চমস্কি তত্ত্বের প্রয়োগ-পদ্ধতি নিয়ে যাঁরা ভাবছেন তাঁদের মধ্যে প্রবাল দাশগুপ্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ইনি চমস্কি চিন্তাকে বাংলার বাক্য-অবয়বে প্রয়োগ করে বাংলার গঠনরহস্যকে যেমন ধরবার চেষ্টা করছেন, তেমনি বাংলা ব্যাকরণের সমস্যাগুলির সমাধান সূত্রও খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছেন । উদয়নারায়ণ সিংহ এই নূতন ভাষাচিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভাষা পরিকল্পনা ও ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করে চলেছেন। সম্প্রতি অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ ভাষা জিজ্ঞাসায় সাধারণ ভাষাতত্ত্বের আলোচনা করে তারই পটভূমিতে চঞ্চিতত্ত্ব সহজভাবে আলোচনা করেছেন । তিনি সাম্প্রতিক ভাষাচিন্তাকে সামাজিক ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন ।
বাংলাদেশের আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, রাজীব হুমায়ুন, মহম্মদ দানিউল হক, রফিকুল ইসলাম, ভাষাগবেষকেরা নূতন ভাষাচিন্তামরুজ্জমান, মনসুর মুসা প্রমুখ মাধ্যমে বাংলা ব্যাকরণে নতুন ঢেউ আনতে আগ্রহী। আমরা আশা করব এঁদের মিলিত চেষ্টা বাংলা ভাষার নূতন ব্যাকরণ রচনায় ফলপ্রসূ হবে । (বাংলা ভাষার ব্যাকরণ – জ্যোতিভূষণ চাকী )