HEADER ADDS

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর - জ্ঞানদাস

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

 

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে ৷৷

সই, কি আর বলিব।

যে পণ কর‍্যাছি মনে সেই সে করিব ।

রূপ দেখি হিয়ার আরতি নাহি টটে।

বল কি বলিতে পারি যত মনে উঠে

দেখিতে যে সংখ উঠে কি বলিব তা।

দরশ পরশ লাগি আউলাইছে গা ৷৷

হাসিতে খসিয়া পড়ে কত মধু-ধার ।

লহু লহু , হাসে পঁহু পিরীতির সার ।।

গরু গরবিত মাঝে রহি সখী-সঙ্গে ।

পুলকে পুরয়ে তন, শ্যাম পরসঙ্গে।

পুলক ঢাকিতে করি কত পরকার ।

নয়নের ধারা মোর বহে অনিবার ।।

ঘরের যতেক সবে করে কানাকানি।

জ্ঞান কহে লাজ-ঘরে ভেজাই আগুনি ৷৷

 

আলোচ্য পদটি বৈষ্ণব পদাবলীর রূপানুরাগ পর্যায়ের অন্তর্গত। পদটি চৈতন্য পরবর্তীকালের বৈষ্ণব মহাজন  জ্ঞানদাসের রচিত।

 

শব্দার্থ –  

ঝুরে -  পড়ে । গুণে মন ভোর—তাঁর গণের বৈশিষ্ট্যে মন পরিপূর্ণ থাকে ৷ হিয়ার – হৃদয়ের । পরশ – স্পর্শ । কান্দে -  ক্রন্দন করে ৷ পরাণ – প্রাণ ।  পিরীতি – প্রীতি । লাগি - জন্য।  থির – স্থির  । বান্ধে – বাঁধে । আরতি – আর্তি ।   থির—স্থির। টুটে – ভাঙে । দরশ – দর্শন ।  পরশ-  স্পর্শ— ; আউলাইছে- আকুল হয়েছে । মধু-ধার—মধর ধারা ; লহু লহু – মৃদু  মৃন্দ ।  পঁহু - প্রভু। সার- নির্যাস । গরু গরবিত – গুরুজন  ও পূজনীয়গণ।  পরকার—প্রকার  পরসঙ্গে - প্রসঙ্গে  অনিবার – অবিরাম ।লাজ- লজ্জা । আগুনি -  আগুন ।

 

আলোচনা

কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা নবানুরাগিনী রাধা বলছেন যে কৃষ্ণের রূপের জন্য তাঁর নয়ন থেকে অবিরল ধারায়  অশ্রুপাত হয় কৃষ্ণের গুণে রাধার  মন বিভোর হয়ে পড়ে। কৃষ্ণের রূপ-গুনে মগ্ন রাধার প্রতিটি অঙ্গের জন্য  প্রতিটি অঙ্গ কাঁদতে থাকে। বিচ্ছিন্নতা বা দূরত্ব আর সহ্য হয় না । হৃদয়ের স্পর্শের জন্য হৃদয় কেঁদে ওঠে, রাধার প্রাণ প্রেমের জন্য অস্থির যে প্রতিজ্ঞা রাধা করেছেন তা পরণের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রূপ দেখে আর প্রাণের মনে মনে আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হয় না। দেখতেই যে কত সুখ তা  বর্ণনা করা যায় না! দর্শন ও স্পর্শে’র আশায় শরীর ক্রমশঃ এলিয়ে পড়ছে। তাঁর হাসিতে কত না মধুর  ধারা ঝরে পড়ে। সখীদের নিয়ে যখন গুরুজন  ও পূজনীয়দের মধ্যে রাধা থাকেন তখন শ্যামের প্রসঙ্গে তাঁর দেহমন পলকিত হয় পুলক-রোমাঞ্চ যাতে প্রকাশিত না হয় তার জন্য তিনি বিভিন্ন  চেষ্টা করেন কিন্তু প্রবহমান অশ্রুর ধারা সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। রাধার এই অবস্থা দেখে ঘরের মধ্যে সকলে কানাকানি করে। জ্ঞানদাস বলেছেন—রাধার যেন লজ্জা ও ঘরের মুখে আগুন জালিয়ে দেয়।

      আলোচ্য পদটিতে কৃষ্ণ-কামনায় রাধার ব্যাকুলতা ও বেদনা শতধারায় বর্ষিত । কৃষ্ণের রূপের. আকর্ষণে ও গুণের ঐশ্বর্যে শ্রীরাধা কৃষ্ণের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনূভব করেছেন। শ্রীমতী কৃষ্ণের প্রতি তাঁর দেহগত আকর্ষণকে গোপন করেননি । কবিতাটির প্রতি ছত্রে কৃষ্ণকে পাবার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে—কৃষ্ণের রূপরাশি যে আগুন শ্রীমতীর হৃদয়ে জালিয়ে দিয়েছে—কৃষ্ণের সঙ্গে মিলন বিনা তা যে প্রশমিত হবার নয় তা কবি জ্ঞানদাস জানিয়ে দিয়েছেন। শেষ ছত্রে তাই শ্রীরাধার প্রতি কবির উপদেশ কৃষ্ণকে পাওয়ার প্রতিবন্ধক লজ্জা ও গৃহের মখে যেন তিনি আগুন জ্বালিয়ে দেন । ভাষা, আবেগ ও চিত্রপ্রতীকের দুরন্ত ব্যবহারে এখানে যে মর্ত্যচেতনার প্রকাশ ঘটেছে বৈষ্ণব কাব্যে তা বিরল দৃষ্টান্ত। কবিতাটির প্রথম চার চরণে  মর্ত- প্রীতির কথা বলতে গিয়ে রসজ্ঞ সমালোচক বলেছেন-

 
উদ্ধৃতিটির অনুরূপ রক্তের অণু-পরমাণুর এতবড় গীতি ক্রন্দন বৈষ্ণব সাহিত্যে নাই। অনন্ত বাসনার অনন্ত হাহাকার মাত্র চার ছত্রের মধ্যে যে ভাবে ধরা পড়িয়াছে তেমন মহাবিস্ময় কাব্যেতিহাসে অল্পই ঘটিয়াছে। নিখিল মানবের বেদনা কোন এক ক্ষুদ্র মানবকণ্ঠে উৎসারিত হওয়া সম্ভব,
এ কথা কে বিশ্বাস করিত যদি ঐ অসম্ভব অতি— কয়েকটি পয়ার ছত্র