রূপক অলংকার
যা সাহিত্যের ভাষার সৌন্দর্য ও মাধুর্য বৃদ্ধি করে তাই অলংকার ‘অলংকার’ এর আভিধানিক অর্থ হলো গহনা, ভূষণ, আভরণ ইত্যাদি। তাই সাহিত্যের সৌন্দর্য
বৃদ্ধির জন্য ভাষা প্রয়োগের একটি বিশেষ রীতির নাম অলংকার। প্রাচীনকাল থেকেই দণ্ডী, বামন, বিশ্বনাথ কবিরাজসহ
বিভিন্ন আলঙ্কারিকরা নানাভাবে অলংকার নিয়ে আলোচনা করেছেন ।
অলংকারের কাজ কী ? এর উত্তরে কেউ কেউ বলেছেন – ‘অলঙ্কারোহি চারুত্বহেতুঃ’ অর্থাৎ অলঙ্কারের কাজ
আনন্দবর্ধন করা। ।‘অলঙ্কার’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ সুসজ্জিতকরণ বা বিভূষিতকরণ।
প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রবিদগণ বলেছেন- ‘সৌন্দর্যম্ অলংকারঃ’। অর্থাৎ সৌন্দ্যর্যই
অলঙ্কার । কেউ কেউ মনে করেন, অর্থাৎ ‘সহজ ভাষায় বলা যায়, শব্দে সাধারণ অর্থের অতিরিক্ত এক চমৎকারিত্ব সৃষ্টিই হলো অলঙ্কার।
অলঙ্কারের প্রকারভেদ : অলঙ্কারকে প্রধানত দুই ভাবে ভাগ করা হয়।
যথা- ১. শব্দালঙ্কার ও ২. অর্থালঙ্কার।
শব্দালংকার:- শব্দের বহিরঙ্গ ধ্বনির আশ্রয়ে যে কাব্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়
তাকে বলে শব্দালংকার।
শব্দালংকারের শ্রেণিবিভাগ : শব্দালংকার পাঁচ প্রকার। যথা –
(ক) অনুপ্রাস (খ)
যমক (গ) শ্লেষ (ঘ) বক্রোক্তি (ঙ) পুনরুক্তবদাভাস
অর্থালংকার শ্রেণিবিভাগঃ প্রধানত পাঁচ ধরনের অর্থালংকার হয় –
(ক) সাদৃশ্যমূলক (খ)
বিরোধমূলক (গ) শৃঙ্খলামূলক (ঘ) ন্যায়মূলক (ঙ) গূঢ়ার্থ প্রতীতিমূলক
আলোচনা করবো –
রূপক অলংকার কাকে বলে ?
রূপক অলংকার কত প্রকার ?
রূপক অলংকারের উদাহরণ ।
আরও পড়ুন -
রূপক অলংকার
আচার্য বিশ্বনাথ কবিরাজ তার সাহিত্যদর্পণ গ্রন্থের দশম পরিচ্ছেদে এর লক্ষণ
প্রসঙ্গে বলেছেন-
“রূপকং রূপিতরোপ: বিষয়ে নিরপহ্নবে”
সংজ্ঞা – উপমেয়ের সাথে উপমানের অভেদ কল্পনা করা হলে রুপক অলংকার হয়
।
· একটি বস্তুর উপর অন্য একটিকে এমনভাবে স্থাপন করা, যাতে দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে আপনার রূপে রূপায়িত ক'রে তোলে। এই কল্পনার ফলে দুটি বিজাতীয় বস্তুকে এক ব'লে মনে হয়।
· বস্তুগতভাবে উপমেয় উপমান বিভিন্ন হ'লেও তাদের অতিসাম্য দেখাবার জন্যই কাল্পনিক অভেদ আরোপের নাম রূপক।
· রূপকে উপমান উপমেয়কে গ্রাস করে না ।
· রূপক অভেদপ্রধান অলঙ্কার।
· উপমা অলঙ্কারে উপমেয়টি মূল্যবান , কিন্তু রূপকে মূল্য বেশী
উপমানের।
· উপমান উপমেয়কে গ্রাস না করলেও আচ্ছন্ন করে।
· রূপকে ক্রিয়াটি উপমানের অনুযায়ী ।
· বাক্যে উপমেয় এবং উপমানের উল্লেখ থাকবে, সাদৃশ্যবাচক শব্দ থাকবে না।
(i)
“তোমাদেরে তবে বাঁশরী করিয়া বাজাইব বনমাঝে” (তোমাদেরে ললিতা প্রভৃতিকে)।
(ii)
"ফুলগুলো ধায় ফড়িঙ, হ'য়ে উড়নফুলের রূপ ধ'রে"
(iii)
"তিলে তিলে আমি তব মৃত্যু হবো, নিঃশেষ করিব
তোমা!"
রূপকের প্রকারভেদ –
(i) নিরঙ্গ রূপক
(ii) সাঙ্গ রূপক
(iii) পরস্পরিত রূপক
(iv) অধিকারূঢ়বৈশিষ্ট্য রূপক
(i) নিরঙ্গরূপক - যে রূপক অলংকারে একটি উপমেয়ের ওপর
একটি বা একাধিক উপমানের অভেদ আরোপ করা হয়, তার নাম নিরঙ্গরূপক।
নিরঙ্গরূপক দু-রকমের।
(i)
কেবল নিরঙ্গরূপক
(ii)
মালা নিরঙ্গ রূপ
একটি উপমানের অভেদ আরোপ হলে কেবল নিরঙ্গরূপক। আর একাধিক উপমানের অভেদ আরোপ হলে
মালা নিরঙ্গরূপক।
১. কেবল নিরঙ্গরূপক (একটি উপমেয়, একটি উপমান)
উদাহরণ –
(i) "আত্মগ্লানির
তুষানল আজ তাহাকে আর তেমন করিয়া দগ্ধ করিতেছিল না।”
(ii) “লজ্জার বারিধিও আজ ততটা
দুস্তর বলিয়া বোধ হইল না।”
(iii) "এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ
করলে ফলতো সোনা ।"
(iv) "দেখিবারে আঁখি পাখি ধায় "
(v) চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে
ডাকি
কোথায় ঘোড়সওয়ার ।
(vi) "আসল কথাটা চাপা দিতে, ভাই, কাব্যের জাল বুনি"
(vii) “শিশুফুলগুলি তোমারে ঘেরিয়া ফুটে"
সংকেত : উপমেয় 'শিশু', উপমান 'ফুলগুলি'। ক্রিয়াপদ 'ফুটে ফুলগুলি'র অনুসারী। 'শিশু'র ওপর 'ফুলগুলি'র অভেদ আরোপ
২. মালা নিরঙ্গরূপক (এখানে একটি উপমেয় এবং একের বেশি উপমান থাকে)
উদাহরণ -
(ক) আমি কি তোমার উপদ্রব, অভিশাপ,
দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপ্ন, করলগ্ন কাঁটা?
সংকেত: উপমেয় - 'আমি', উপমান - 'উপদ্রব, 'অভিশাপ', 'দুরদৃষ্ট', 'দুঃস্বপন', 'কাঁটা'। একটি উপমেয়ের ওপর পাঁচটি উপমানের
অভেদ আরোপ।
(খ) ওই আমাদের চোখের মনি , ওই আমাদের
বুকের বল –
ওই আমাদের অমর প্রদীপ , ওই আমাদের
আশার স্থল ,
ওই আমাদের নিখাদ সোনা , ওই আমাদের
পূণ্যফল
আদর্শে যে সত্য মানে – সে ওই
মোদের ছেলের দল ।
সংকেত: উপমেয় – ছেলের দল , উপমান - চোখের মনি , বুকের বল , অমর প্রদীপ
, আশার স্থল , নিখাদ সোনা , পূণ্যফল
(গ) আমি পিনাক-পানির ডমরু , ত্রিশূল
, ধর্মরাজের দণ্ড,
আমি চক্র , মহাশঙ্খ , আমি প্রণবনাদ
প্রচণ্ড ।
সংকেত: উপমেয় – আমি , উপমান - ডমরু
, ত্রিশূল , ধর্মরাজের দণ্ড, চক্র , মহাশঙ্খ
, প্রণবনাদ প্রচণ্ড
(ঘ) শীতের ওঢ়নি পিয়া গিরীষের বা
বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না
।
সংকেত: উপমেয় – পিয়া , উপমান - শীতের ওঢ়নি গিরীষের বা (বাতাস) বরিষার ছত্র (ছাতা) দরিয়ার না (নৌকা)
(ঙ) শেফালি সৌরভ আমি , রাত্রির নিশ্বাস
ভোরের ভৈরবী ।
সংকেত: উপমেয় – আমি , উপমান - শেফালি
সৌরভ , রাত্রির নিশ্বাস , ভোরের ভৈরবী
(ii) সাঙ্গরূপক - বিভিন্ন অঙ্গসমেত অঙ্গী উপমেয়ের সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গসমেত অঙ্গী উপমানের
অভেদ কল্পনা করলে সাঙ্গরূপক অলঙ্কার হয় ।
শোকের ঝড় বহিল সভাতে;
শোভিল চৌদিকে সুরসুন্দরীর
রূপে
বামাকুল;
মুক্তকেশ মেঘমালা; ঘন
নিশ্বাস প্রবলবায়ু অশ্রুবারিধারা
আসার;
জীমূতমন্দ্র হাহাকার রব!
এখানে শোকের সঙ্গে ঝড়ের রূপক
হযেছে। অর্থাৎ শোকের ঝড়ের রূপ ধারণ করেছে।
এবং অঙ্গী উপমেয় শোকের অঙ্গ হয়ে এসেছে বামাকুল, মুক্তকেশ, ঘননিশ্বাস,
অশ্রুবারিধারা, হাহাকার রব তেমনি আবার অঙ্গী উসমান ঝড়-এর অঙ্গ হয়েছে সুরসুন্দরী (বিদ্যুৎ), মেঘমালা,
প্রবলবায়ু, আসার (বর্ষণ), জীমূতমন্দ্র (মেঘগর্জন)।
এই সাঙ্গরূপক মোটামুটি দুরকমের - (i) সমস্তবস্তুবিষয়ক এবং (ii) একদেশবিবর্তি
(i) সমস্তবস্তুবিষয়ক - যে উপমানগুলি আরোপিত হয়, তাদের সবগুলিই যদি শব্দপ্রয়োগে প্রকাশিত হয়, তাহ'লে সমস্তবস্তুবিষয়ক সাঙ্গরূপক পাওয়া যায়।
(ক) "কোদালে'
মেঘের মউজ উঠেছে
আকাশের নীলগাঙে
হাবুডুবু খায় তারাবুদবুদ।"
এখানে উপমেয় - আকাশ ( মেঘ,
তারা আকাশের অঙ্গ )
উপমান
- নীলগাঙ (মউজ (ঢেউ), বুদবুদ নীলগাঙের অঙ্গ)
(খ) "হৃদিবৃন্দাবনে বাস কর যদি কমলাপতি ওহে ভক্তিপ্রিয়, আমার ভক্তি হবে রাধা সতী।
মুক্তিকামনা আমারি
হবে বৃন্দা গোপনারী
দেহ হবে নন্দের পুরী স্নেহ হবে মা যশোমতী॥"-দাশরথি।
(ii) একদেশবিবর্তি সাঙ্গরূপক -উপমানগুলির কোনোটি বা কোনো কোনোটি
যদি ভাষায় স্পষ্টভাবে প্রকাশিত না হ'য়ে,
অর্থে বা ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়, তবেই হয় একদেশবিবর্ত্তি সাঙ্গরূপক।
(ক) 'লাবণ্যের মধুভরা বিকশিত তন্বীর বয়ান পুরুষের আঁখিভৃঙ্গ কেন বল না করিবে পান?'
-মুখের লাবণ্যকে মধু বললে মুখকে ফুল বলতে হয়। কিন্তু কবি মুখকে ফুল বলেন নাই; তবু অর্থে তা চমৎকার বোঝা যাচ্ছে-'বিকশিত'
হওয়া মুখের পক্ষে সম্ভব নয় ব'লে এটি ফুলের দিকেই নির্দেশ দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, ফুল উপমান ।
(খ) "নীলপাহাড়ের ফুলদানীতে প্রফুল্ল জাফরানীস্থান!"
-নীলপাহাড়কে ফুলদানী করা হয়েছে। ফুলদানীতে ফুল থাকে; কাজেই জাফরানীস্থানে ফুল আরোপ করা হয়েছে- 'প্রফুল্ল'
শব্দটি ঐ নির্দেশই দিচ্ছে। কবি ফুল শব্দটি ব্যক্ত করেন নাই; কিন্তু অর্থে বোঝা গেল।
(গ) কবিতারসের সরে
রাজহংসকুলে
"কেমনে
মিলি করি কেলি আমি...?"
(ঘ) "আকাশের সর্বরস রৌদ্ররসনায় লেহন করিল সূর্য।”
(iii) পরম্পরিত রূপক
যদি একটি উপমেয়ে উপমানের আরোপ অন্য উপমেয়ে তার উপমানের আরোপের কারণ হয়, তবেই হয় পরম্পরিত রূপক
[এ অলঙ্কারে রূপকে রূপকে কার্য্যকারণভাবের পরম্পরা
ব'লে এর নাম পরস্পরিত। ]
(ক) "কেমনে বিদায় তোয়ে করি, রে বাছনি,
আঁধারি হৃদয়াকাশ তুই
পূর্ণশশী
আমার?" –
তুই (ইন্দ্রজিৎ)-তে পূর্ণশশীর আরোপই হৃদয়ে আকাশারোপের কারণ।
(খ) "চেতনার নটমঞ্চে নিদ্রা যবে ফেলে যবনিকা,
অচেতন-নেপথ্যের অভিনয় কর প্রযোজন।"
-চেতনাকে নটমঞ্চ ব'লে রূপক করাই নিদ্রাকে
যবনিকা এবং অচেতনকে নেপথ্য ব'লে রূপক করার কারণ।
(গ) "শ্যামণ্ডকপাখী সুন্দর নিরখি
(রাই) ধরিল নয়নফাঁদে।
হৃদয়পিঞ্জরে রাখিল তাহারে মনহি শিকলে বেঁধে ॥"
-শ্যামকে শুকপাখী ব'লে রূপক করাই নয়ন, হৃদয় এবং মনকে যথাক্রমে ফাঁদ, পিঞ্জর এবং শিকল
ব'লে রূপক করার কারণ। এখানে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ না থাকায় সাঙ্গরূপক হ'ল না,
কার্য্যকারণ-সম্পর্ক থাকায় পরস্পরিত রূপক হ'ল।
(ঘ) জীবন উদ্যানে তোর যৌবন কুসুম ভাতি কতদিন রবে
।
(ঙ) মরনের ফুল বড়ো হয়ে ওঠে জীবনের উদ্যানে ।
(iv) অধিকারূঢ়বৈশিষ্ট্য রূপক
উপমানে কোনো অসম্ভব ধর্ম্মের কল্পনা ক'রে যদি সেই অসম্ভব ধৰ্ম্মযুক্ত উপমাঙ্কে উপমেয়ে আরোপ করা হয়, তবে এই অলঙ্কার হয়।
(ক) "বয়ন শরদসুধানিধি নিষ্কলঙ্ক"-জ্ঞানদাস।
-(রাধার) বদন শরচ্চন্দ্র; কিন্তু চন্দ্রে
কলঙ্ক আছে,
রাধামুখে নাই।
চাঁদের পক্ষে নিষ্কলঙ্ক হওয়া তো সম্ভব নয়; তবু কবি এই অসম্ভবকে কল্পনা ক'রেই 'নিষ্কলঙ্ক'
চাঁদকে আরোপ করেছেন রাধার 'বয়ন'
(বদন)-এ।
(খ) "ও নব জলধর অঙ্গ; ইহ থির বিজুরীতরঙ্গ।”
বিদ্যুৎতরঙ্গকে স্থির (থির) কল্পনা ক'রে তবে রাধায় আরোপ করা হয়েছে কিন্তু বিদ্যুৎ স্থির নয়
।
(গ) "নাহি কালদেশ তুমি অনিমেষ মুরতি, তুমি অচপল
দামিনী” -রবীন্দ্রনাথ।
দামিনী অচপল নয় , চপল ।
(ঘ) "অপরূব পেখমু রামা ...হরিণহীন হিমধামা"-বিদ্যাপতি।
(হরিণ - কলঙ্ক; হিমধামা - চন্দ্র; রামা রাধা)
(ঙ) "থির বিজুরী নবীনা গোরী পেখমু ঘাটের কূলে"
ONLINE BENGALI SLST/PSC/MSC CLASS
OFLINE BENGALI SLST CLASS
PDF NOTES
DAILY ONLINE MOCK TEST
SLST PREPERATION এর জন্য যোগাযোগ করতে - ক্লিক কর