জীবনানন্দ দাশের কবিতা আকাশে সাতটি
তারা
আজকের আলোচনাতে আমরা আকাশে সাতটি
তারা কবিতার প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো না । আমরা যে আলোচনা করবো সেই আলোচনাটি
ভালো ভাবে পড়লে আকাশে সাতটি তারা কবিতার ছোট প্রশ্নোত্তর বা আকাশে সাতটি তারা কবিতার
বড় প্রশ্নোত্তর সব কিছুই করা যাবে ।
আকাশে সাতটি তারা কোন শ্রেণির কবিতা
এই প্রশ্নের উত্তরে
আমরা বলতে পারি আকাশে সাতটি তারা কবিতাটি একটি নিসর্গ প্রেমের কবিতা ।
রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যকে জীবনানন্দ
দাশ যে পরিচিতি দান করেছিলেন ,তা এক কথায় অনবদ্য । ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ই অক্টোবর ট্রাম দুর্ঘটনায়
গুরুতর আহত হন এবং ২২ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয় । অবসান হয় বাংলা সাহিত্যের সম্ভাবনাময়
একটি যুগের ।
আমাদের আলোচ্য আকাশে সাতটি তারা কবিতায় বঙ্গ প্রকৃতির প্রতি কবির এক প্রগাঢ় ভালোবাসার
প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি । কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর অনুভূতি দিয়ে বাংলাদেশের জল,আকাশ,মাঠ,ঘাট,পশু
পাখি,কীটপতঙ্গ ,লতাপাতা সমস্ত কিছুকে মন্থন করেছেন । বাংলার নিসর্গ কবি জীবনানন্দকে
এক আত্মময় প্রগাঢ় ভালোবাসায় নিমগ্ন করেছে । তাই তিনি বলেন –
তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও- আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব ;
আকাশে সাতটি তারা কবিতাটি জীবনানন্দ
দাশের রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের ৬ নং কবিতা । রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি
কবির মৃত্যুর পর তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় । এই কাব্যের কবিতাগুলির
কোনো নাম কবি দেননি ।
আরও পড়ুন
বেলাশেষের সূর্যের রক্তিম আভায় মেঘের
রঙ হয়ে ওঠে কামরাঙা লাল। সমাগত সন্ধ্যার রহস্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘাসের উপরে বসে
কবি অনুভব করেন দিনের অবসান ও সন্ধ্যার সমাসন্নতা। তিনি লক্ষ্য করেন কামরাঙা লাল মেঘ
মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেলে ,বাংলার বুকে নামে নীল ,শান্ত,অনুগত সন্ধ্যা
। মনিয়া পাখি যেমন জীবনবৃন্ত থেকে চ্যুত হয়,তেমনি কামরাঙা লাল মেঘ সূর্যের শেষ অস্তরাগ
মেখে গঙ্গাসাগরের বুকে ডুবে যায় ( তবে ‘মনিয়া’ শব্দটির ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে ।
কারো কারো মতে শব্দটির আদি অর্থ হল গ্রীক-ল্যাটিন। যার অর্থ হল শিশুকন্যা)। এই অংশে
কবি জীবনের যে অনিত্যতা, ক্ষণস্থায়িত্ব তাকে প্রকাশ করেছেন । দিনের শেষ আলো-কে মুছে
ক্রমে অন্ধকার ঘনীভূত হয়,কবি ঘাসের উপরে বসে আকাশে সাতটি তারার ফুটে ওঠা লক্ষ্য করেন
। অন্ধকারের বুক চিরে হীরক খণ্ডের মতো সাতটি তারা জ্বলজ্বল করে । এই তারার জেগে ওঠা
অন্ধকারকে আরো ঘনীভূত করে । পুঞ্জীভূত এই অন্ধকার কবির চোখে শুধু প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা
নয়, এই অন্ধকার কবি চোখে ধরা দেয় মানবী রূপে । সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারকে কবি কল্পনা
করেন কেশবতী কন্যা রূপে । রূপসী কেশবতী কন্যা যেন তার পেলব ঘনকৃষ্ণ কেশরাশি ধীরে ধীরে
ছড়িয়ে দেয় সমস্ত প্রকৃতিতে । রূপসী কন্যার এলায়িত চুল স্নেহ-চুম্বন এঁকে দেয় কাঠাল-হিজল-জামের
শাখায় শাখায়। কবি চেতনা করে আচ্ছন্ন। কবি তাঁর চোখে-মুখে সেই আচ্ছন্নতাকে অনুভব করেন
। বাঙলার এই মায়াবী সন্ধ্যা যে মোহময়তা সৃষ্টি করে,তা অনাড়ম্বর,বৈভবহীন।কিন্তু তার
সরল ঐশ্বর্য কবিকে আবিষ্ট করে । তাই কবি বলেন –
পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখে নি কো
রূপসীর চুলের বিন্যাসে যে স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে তা কবি চেতনাকে এক অপরূপ লাবণ্যে
ভরিয়ে দেয় ।
ঘনায়মান সন্ধ্যার লাবণ্যময় অন্ধকারে
রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ-স্পর্শময় নৈসর্গিকতায় প্রাণের স্পন্দন অনুভব করেন কবি । নরম ধানের
গন্ধ কবিকে আপ্লুত করে । কলমি শাক, পুকুরের জল,শর, চান্দা-সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ কবি
অন্তর থেকে অনুভব করেন । বাঙলার একান্ত অনুষঙ্গগুলি এক অনন্যমাত্রায় কবি চোখে ধরা দেয়
। কিশোরের পদদলিত ঘাসে,কিশোরীর চালধোয়া ভিজে হাতের মমতা মাখা উষ্ণতায় এবং ঝরে পড়া বটফলের
ব্যথিত পরিণতির মধ্যে দিনান্তের ক্লান্ত নীরবতাকে কবি খুঁজে পান ।
লোকায়ত জীবনের অনুষঙ্গকে জীবনানন্দ
দাশ বার বার তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন পরম অন্তরঙ্গতায় । কারণ রিনি মনে করেন লোকজীবনের
সাহচর্যেই প্রকৃতির অন্তরঙ্গতা পূর্ণতা পায় । তাই কিশোরীর চাল ধোয়ার অনুষঙ্গকে মমতা,ভালোবাসা,আন্তরিকতা
প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছেন । বাংলার অন্তরে যে মানসিক উষ্ণতা,যে দরদ,যে
আর্তি ও অনুরাগ আছে তাকে কবি কিশোরীর ‘শীত হাতখান’ শব্দবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন
। হৃদয় মনের এক ক্লান্তি,বিষন্নতাকে কবি অনুভব করেছেন দিন শেষের সন্ধ্যায় । বটফলের
ঝরে পড়ার ব্যথিত পরিণতির মধে যে বিষন্নতা থাকে ,যে ক্লান্তি থাকে ,যে মন খারাপের অনুভূতি
থাকে তাকেই কবি সন্ধ্যার ক্লান্তি,বিষন্নতার সঙ্গে সঞ্চারিত করেছেন । এরই মাঝে কবি
বাঙলার প্রাণকে অনুভব করেন । তাই কবি বলেছেন –
… এরই মাঝে বাংলার প্রাণ;
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের ।
এই নীলাভ মায়াবী রহস্যময় অন্ধকার কবির মনোজগতকেও প্রভাবিত করে । কবির চিন্তা-চেতনাকে
মোহাবিষ্ট করে । ‘আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে’ বা ‘আকাশে সাতটি
তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের ।’ পংক্তিগুলি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
আঙ্গিকগত দিক দিয়ে আকাশে সাতটি তারা একটি সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা । একটি অখণ্ড ভাবকল্পনাকে
কবি চৌদ্দটি চরণে সীমাবধ রেখে প্রকাশ করেছেন । অষ্টকে পল্লিবাংলার নিসর্গ রূপের বর্ণনায়
যে ভাবের বিস্তার ঘটেছে ষটকে বাংলার একান্ত অনুষঙ্গগুলির মাধ্যমে কবির অনুভূতি ও প্রকৃতিপ্রাণতা
প্রকাশিত হয়েছে ।