প্রবন্ধ কাকে বলে ? প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর । তন্ময় প্রবন্ধ ও মন্ময় প্রবন্ধ
সাহিত্যকে সাধারণত ভাবের সাহিত্য
ও জ্ঞানের সাহিত্য এই দুই ভাগে ভাগ করা হয় । প্রবন্ধ হল জ্ঞানের সাহিত্য । সাধারণত
প্রবন্ধ কোনো বিষয়বস্তুকে বা দৃষ্টি ভঙ্গীকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপিত করে ।
প্রবন্ধ কথাটির ধাতুগত অর্থ প্রকৃষ্ট
বন্ধন । ভাবনা ও মত প্রকাশ যখন যুক্তির বন্ধনে বাঁধা পড়ে তখন তাকে প্রবন্ধ বলে ।
‘প্রবন্ধ' বা 'Essay' এক বিশেষ ধরনের গদ্যরচনা, ষোড়শ শতকে ফরাসি লেখক Michel de Montaigne তার 'Essais' (1580) গ্রন্থের শিরোনামে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন 'essai' বা 'attempt', অর্থাৎ প্রয়াস' এই মূলগত অর্থে।
Montaigne ও বেকনেরও বহু পূর্বে প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমে প্রবন্ধধর্মী গদ্যরচনার চর্চা
করেছিলেন। থিওফ্রাসটাস, প্লুতার্ক, সিসেরো এবং সেনেকা।
প্রাচীন প্রয়োগে 'প্রবন্ধ' শব্দটির অর্থ ছিলো 'উপায়' বা 'ব্যবস্থা'। সংস্কৃত ভাষায় ‘প্রবন্ধ’ বলতে
বোঝাতো 'প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন' এবং সাহিত্যের সকল
শাখাতেই প্রবন্ধের চলন ছিল। স্কটল্যাণ্ডের ষষ্ঠ জেমস
Essay শব্দটি ইংরেজিতে প্রথম ব্যবহার করেন ।
প্রবন্ধ শব্দটি আলংকারিক বিশ্বনাথ তাঁর সাহিত্য দর্পনে ব্যবহার করেছিলেন কাব্যের বিভিন্ন উপাদানের সংগতি
বোঝাতে ।
প্রখ্যাত সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস তাঁর 'সাহিত্যে সন্দর্শন' গ্রন্থে প্রবন্ধ
সাহিত্য সম্পর্কে বলেছেন “কল্পনা ও বুদ্ধি বৃত্তিকে আশ্রয় করিয়া লেখক কোনো
বিষয়বস্তু সম্বন্ধে যে আত্মসচেতন নাতিদীর্ঘ সাহিত্যরূপ সৃষ্টি করেন, তাহাকেই প্রবন্ধ বলা হয়।
ড. উজ্জ্বলকুমার মজুমদার তাঁর সাহিত্যের রূপ ও রীতি গ্রন্থে প্রবন্ধ সম্পর্কে বলেছেন—“যে-কোনো সংক্ষিপ্ত গদ্য রচনা বা
বিষয়বস্তুকে আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপিত করে, কিংবা কোনো বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে কিংবা কোনো বিষয়ের অন্তর্গত
বক্তব্যকে নিষ্কাশিত করে যুক্তির মাধ্যমে পাঠককে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য
করে তাকেই সাধারণ ভাবে প্রবন্ধ বলা হয়।
প্রবন্ধকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়-
১। Formal
Essay বা বিষয় গৌরবী কিংবা বস্তুগত প্রবন্ধ।
২। Informal
বা Familiar essay কিংবা Intimat
essay বাংলায় যাকে বলা হয়-আত্মগৌরবী বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ।
এ দুটিকে আবার তন্ময় ও মন্ময় প্রবন্ধ রূপে আখ্যাত করা যেতে পারে। বস্তুনিষ্ঠ
প্রবন্ধ সম্পর্কে শ্রীশচন্দ্র দাস বলেছেন—“বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ আমাদের বুদ্ধিকে
তীক্ষ্ণতর, দৃষ্টিকে সমুজ্জ্বল ও
জ্ঞানের পরিধিকে প্রশস্ত করিয়া তোলে।" আর ব্যক্তিগত প্রবন্ধ সম্পর্কে বলেছেন 'মন্ময় বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধে জ্ঞানের বিষয়কে হাস্যরস মণ্ডিত পুষ্প পেলবতা
দান করিয়া আমাদিগকে মুগ্ধ করে।" অর্থাৎ বস্তুগত
প্রবন্ধে কেবলমাত্র বিষয়ের প্রাধান্য স্বীকৃত হয় যেখানে মানবমনের বা
প্রাবন্ধিকের কোনো স্থান নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত
প্রবন্ধে লেখকই প্রাধান্য পায়। কোনো বিষয় সেখানে অনুপ্রবেশ করে লেখকের
উদ্দেশ্যকে বিপথে চালিত করতে পারে না।
বিষয় গৌরবী প্রবন্ধ :
যে প্রবন্ধে বিষয়বস্তু প্রাধান্য লাভ করে বা মুখ্য রূপে বস্তু বা বিষয়
স্বীকৃত পায় তাকে বিষয় গৌরবী প্রবন্ধ (Formal Essay) বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পুস্তককে এই শ্রেণির শ্রেষ্ঠ উদাহরণরূপে
নির্ণয় করা যায়। এছাড়া অক্ষয় কুমার দত্ত, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ প্রাবন্ধিকের বহু রচনা এই শ্রেণির
অন্তর্ভুক্ত। এখানে লেখক আপন জ্ঞানের দ্বারা যুক্তিসহযোগে নিজ মত প্রতিষ্ঠা করেন।
পাঠকের তোয়াক্কা না করে তিনি আপন সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। সমালোচকের ভাষায় লেখক
এখানে যেন—“বেদীর উপর সমাসীন আচার্য্য বা গুরুদেবের মতো পাঠককে নেহাত অপোগণ্ড শিশু
মনে করিয়া জ্ঞানের আলো-কণিকা বিতরণ করেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, জীবন চরিত,
বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক—আলোচনা মূলক রচনা বা সম্পাদকীয়
প্রবন্ধ এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
এই ধরণের প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
1. যুক্তিনিষ্ঠা ও ভাবনার
নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা থাকবে ।
2. তত্ত্ব ও তথ্যের
লক্ষণীয় প্রাধান্য থাকবে ।
3. প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিগত
আবেগ-অনুভবের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠা ও মননের গুরুত্ব প্রাধান্য পাবে ।
4. প্রাবন্ধিক বৈজ্ঞানিক
তথা বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবেন ।
5. প্রবন্ধের বিষয়
সম্পর্কে প্রবন্ধকারের থাকবে নিঃস্পৃহতা, নিরপেক্ষতা ও আনুষ্ঠানিক মেজাজ ।
6. ভাষা ব্যবহারে সতর্কতা ও
সংযম। ঋজু ও গম্ভীর ভাষার মাধ্যমে প্রবন্ধের বক্তব্য প্রকাশিত ।
7. পাঠকের থেকে দূরত্ব
বজায় রেখে প্রবন্ধকার শিক্ষক বা পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করবেন।
বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ -
১) আলোচনা বা গবেষণাধর্মী
প্রবন্ধ – কোনো একটি বিষয়ে নিবিষ্ট ও সুশৃঙ্খল আলোচনা , বিষয়বস্তুর রসগ্রাহী বিচার
অপেক্ষা তাঁর বস্তু রূপের অনুসন্ধান করা হয় এই শ্রেণির প্রবন্ধে । বঙ্কিম চন্দ্রের
লোকশিক্ষা , দ্রৌপদী এই শ্রেণির প্রবন্ধ
।
(২) বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ : বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহার ও
বিশ্লেষণ যে বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে করা হয় তাকে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বলে ।
বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় প্রথম রচনা করেন অক্ষয়কুমার দত্ত। যুক্তিনির্ভর, বিজ্ঞানমনস্কতা, ভাষার ওজস্বিতা ও
প্রাঞ্জলতা অক্ষয়কুমারের প্রবন্ধাবলীর বৈশিষ্ট্য। এছাড়া
রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব পরিচয় ও জগদীশচন্দ্র বসুর ‘অব্যক্ত’এই শ্রেণীর
উল্লেখনীয় উদাহরণ। রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী , প্রফুল্ল
চন্দ্র রায় এই শ্রেণির প্রবন্ধ রচনা করেন ।
(৩) ঐতিহাসিক প্রবন্ধ : প্রাচীন অথবা সমকালীন ইতিহাসের প্রেক্ষাপট ও
ঘটনাবলী অবলম্বনে তথ্যনির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ
বিশ্লেষণে রচিত হয় ঐতিহাসিক প্রবন্ধ। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখকরা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের
সুদীর্ঘ রচনা ‘বঙ্গদেশের কৃষক’। তথ্যবহুল ও মননশীল এ-প্রবন্ধে বঙ্কিম বঙ্গদেশের কৃষকদের দুরবস্থা, জমিদারদের
অমানবিক দমন-পীড়ন, রাষ্ট্রীয় আইন, কর্নওয়ালিসের
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভয়াবহ ফলশ্রুতি তুলে ধরেছেন
যুক্তিনিষ্ঠা ও হৃদয়বৃত্তির মিশ্রণে। বঙ্কিমের ‘বাঙ্গালির ইতিহাস', ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের
‘পুরাবৃত্তসার’ ও ‘ইংলণ্ডের ইতিহাস' এই শ্রেণীর প্রবন্ধের স্মরণীয় নিদর্শন। ঐতিহাসিক প্রবন্ধের অপরাপর লেখকদের মধ্যে
রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস
বন্দ্যোপাধ্যায় এবং একালের অমলেশ ত্রিপাঠী প্রমুখের নাম করা যায়।
(৪) রাজনৈতিক প্রবন্ধ : রাজনৈতিক চিন্তা, তত্ত্ব,
ঘটনাবলী ইত্যাদি অবলম্বনে লেখা হয় রাজনৈতিক প্রবন্ধ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সাম্য' তাঁর রাজনৈতিক চেতনার ফলশ্রুতি। বর্ণবৈষম্য ও অর্থবৈষম্যের ভয়ানক পরিণতির চিত্রাঙ্কন ও সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণী এই
প্রবন্ধগ্রন্থকে
স্মরণীয় করেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা প্রজা’ ও ‘কালান্তর' শীর্ষক রচনায় দেশ ও কালের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক
চিন্তার ছোঁয়া পাঠককে প্রভাবিত করে। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক প্রবন্ধের রচয়িতারূপে মুজফ্ফর আহমেদ ও নজরুল ইসলামের নাম করা যেতে পারে।
(৫) সামাজিক/সমাজসমস্যামূলক প্রবন্ধ - কোনো সামাজিক বিষয়, প্রসঙ্গ,
সমস্যা, প্রশ্ন ইত্যাদিকে আশ্রয় করে যুক্তি-তর্ক, বিচার-বিশ্লেষণের পথ ধরে লিখিত হয় এ-ধরনের বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ। বিদ্যাসাগরের ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক
প্রস্তাব’,
‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা
এতদ্বিষয়ক বিচার', ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের
‘সামাজিক প্রবন্ধ' ও রবীন্দ্রনাথের 'সভ্যতার সঙ্কট' সামাজিক সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে লেখা সমাজচিন্তা তথা সমাজসংস্কারমূলক প্রবন্ধের উজ্জ্বল উদাহরণ।
(৬) জীবনীমূলক প্রবন্ধ : কোনো বরণীয় ব্যক্তিত্বের জীবন নিয়ে লেখা অথবা
আত্মজৈবনিক
প্রবন্ধের সঙ্গে জীবনী বা জীবনচরিতের পার্থক্য নিয়ে বিতর্ক
হতে পারে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী' এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি জীবনীমূলক প্রবন্ধের গোত্রভুক্ত। জীবনস্মৃতি ঠিক রবীন্দ্র-জীবনকাহিনি নয় ; বাল্য ও কৈশোরকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা জীবন- উপলব্ধির এক মনোজ্ঞ স্মৃতিলেখা। এখান থেকেই জীবনী/জীবন-চরিতের সঙ্গে জীবনীমূলক প্রবন্ধের তফাতটি আন্দাজ করা যাবে।
ব্যক্তিগত প্রবন্ধ :
যে প্রবন্ধে বিষয় চিন্তা অপেক্ষা ব্যক্তি হৃদয়ই প্রাধান্য পায় তাকে মন্ময়
বা ব্যক্তিগত বা আত্মগৌরবী প্রবন্ধ নামে অভিহিত করা হয়। এই প্রবন্ধে কোনো
বস্তুনিষ্ঠ নয়,
ভাবপ্রধান বিষয় আত্মপ্রকাশ করে।
বস্তুগত প্রবন্ধে জ্ঞানের পিপাসা মেটায়, আর ব্যক্তিগত প্রবন্ধে হাস্যোচ্ছ্বলে জীবনের গভীরতম বিষয়কে প্রকাশ করে।
বস্তুগত প্রবন্ধে গুরুগম্ভীর বিষয় মুখ্য হয়ে ওঠে বলে পাঠক চিত্তের উপর তেমন
গভীর প্রভাব ফেলতে পারে না, কিন্তু ব্যক্তিগত
প্রবন্ধের বিষয়বস্তু আকাশের তারকা থেকে মাটির প্রদীপ পর্যন্ত বিস্তৃত।
এই শ্রেণীর প্রবন্ধে ব্যক্তিগত ভাব ও চিন্তা প্রাধান্য লাভ করে। যে শ্রেণীর
প্রবন্ধে যুক্তি-তর্ক বিশ্লেষণ লেখকের মনন জারক রসে পরিপ্লাবিত হয় এবং ব্যক্তিগত
ভাবানুভূতি ও কল্পনা প্রাধান্য লাভ করে সেই শ্রেণীর প্রবন্ধকে ব্যক্তিগত ভাবপ্রধান
প্রবন্ধ বলা যেতে পারে।
যেমন, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের
দপ্তর।
Ø ড. অর্ধেন্দুশেখর বাশুরী এই শ্রেণির প্রবন্ধ সম্পর্কে
জানিয়েছেন - 'লেখকের সৌন্দর্য চেতনা ও রসানুভূতি ব্যক্তিগত প্ৰবন্ধকে
অসামান্যতা দান করে। লেখক এখানে তথ্য বা তত্ত্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন না।
কোন সিদ্ধান্ত বা মীমাংসায় উপস্থিত হবার জন্য তাঁর বিশেষ আগ্রহ বা প্রচেষ্টা
পরিলক্ষিত হয় না। লেখকের ভাব এখানে সহজে পাঠকের হৃদয়ে একটা অদৃশ্য ভাবের যোগ স্থাপিত হয়।
গীতিকবিতার মতো ব্যক্তিগত প্রবন্ধও অন্তরানুভূতি প্রধান। এদিক দিয়ে গীতিকবিতা ও
ব্যক্তিগত প্রবন্ধ অনেকটা সমধর্মী'।
Ø ড. অধীর কুমার দে বলেছেন, লেখকের নিজস্ব দৃষ্টি বা আত্মগত ভাব সৌন্দর্যে মণ্ডিত হইয়া যে-কোনো
বিষয়স্থিত এই জাতীয় প্রবন্ধ বিষয়নিষ্ঠ প্রবন্ধের ন্যায় নিছক জ্ঞান বা
যুক্তিযুক্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা বা সিদ্ধান্তের জন্যই মূল্যবান হয় না—ইহার এমন
একটি মহিমায় আবেদন থাকে, যে আবেদন পাঠক হৃদয়ে গভীরভাবে অনুভূত হয়'।
Ø শ্রীশচন্দ্র দাশ জানিয়েছেন, .....ব্যক্তিগত প্রবন্ধের বিষয়বস্তু জীবনের বাস্তবানুভূতি। ঐতিহাসিক যেমন জীবনকে
ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়া দেখেন, এই শ্রেণীর প্রবন্ধ শিল্পী তেমনটি দেখেন না। জীবনের সীমাহীন ঘটনাপুঞ্জের
যেকোনো একটিই তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট। দার্শনিক যেমন জীবনের পরম সত্য উদ্ঘাটনে, আত্ম নিয়োজিত তিনি
তদ্রুপও নহেন। ঔপন্যাসিক যেমন জীবনের বর্ণনাত্মক রূপসৃষ্টি করেন তিনি তাহাও করেন
না এবং নাট্যকারের মত জীবনকে কর্মময় শোভযাত্রার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন না।
কিন্তু তাঁহার আত্মধ্যানে ইঁহাদের প্রত্যেকেরই স্পর্শ থাকিতে পারে। জীবনের বৈচিত্র্যের
মধ্যে সুর সঙ্গতি সন্ধান তাঁহার কাম্য নয়—তিনি শুধু অপরূপ জীবনকে দুই চক্ষু
ভরিয়া দেখিয়া যান জীবনের আশা-আকাঙ্খার ও বেদনা মধুরতার বিস্ময় রহস্যকে আপন মনের
সমতামধুর মৃদু আলোকসম্পাতে উজ্জ্বল করিয়া তোলেন। (সাহিত্য সন্দর্শন)
Ø রবার্ট লিণ্ড বলেছেন 'Sometimes it is nearly a sermon, sometimes it is nearly
a short story. It may be a fragment of auto- biography, or a piece of nonsense.
It may be satirical or vituperative or sentimental. It may deal with any
subject from the day of judgement to a pair of scissors.'
বলতে দ্বিধা নেই ইংরেজি সাহিত্যে যেমন এই মন্ময় প্রবন্ধে প্রাচুর্য পরিলক্ষিত
হয় বাংলায় তেমন সম্ভার নেই বললেই চলে। কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের
দপ্তর ধ্রুবতারকার ন্যায় একক ক্ষমতায় আসীন। এছাড়া আরও কয়েকজন যেমন রায়গত
ন্যায়রত্ন,
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, চন্দ্রনাথ বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ লেখকগণ এই রচনায় হস্তক্ষেপ করলেও বঙ্কিমের
প্রতিভাকে কেউ ম্লান করতে পারেনি।
এই ধরণের প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
1. যুক্তি ও মননশীলতার পরিবর্তে লেখকের হৃদয়াবেগেরই প্রাধান্য থাকবে ।
2. বিষয়বস্তু লেখকের কল্পনা তথা ভাবরসে জারিত হয়ে পাঠকহৃদয়কে স্পর্শ করবে ।
3. সরস, মর্মস্পর্শী, আত্মগত ভঙ্গিতে পাঠককে
কাছে টেনে নেন প্রাবন্ধিক।
4. বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকারের মতো মন্ময় প্রাবন্ধিক সোচ্চার বা উদ্দেশ্যতাড়িত নন, বরং আত্মমগ্ন ও কিছুটা রহস্যময়
5. ভাবপ্রধান প্রবন্ধ মূলত ব্যক্তিগত, নৈর্ব্যক্তিক নয়।
6. আবেগ ও কল্পনার প্রোজ্জ্বলতায় এ প্রবন্ধ লেখকের ব্যক্তিত্বের দর্পণ ।
7. ভাষার ব্যবহারে প্রবন্ধকার অনেক বেশি স্বাধীনতা পান এবং পাঠকের সঙ্গে আন্তরিক বিনিময় গড়ে তোলেন ।