চেতনা প্রবাহ রীতির উপন্যাস
চেতনা প্রবাহমূলক উপন্যাসের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে গিয়ে পাশ্চাত্য সমালোচক
রবার্ট হামফ্রি বলেছেন- “We way define stream of consciousness fiction as a type of fiction
in which the basic emphasis is placed on explanation of the pre-speech levels
of consciousness for the purpose, primarily, of revealing the psychic being of
the characters.” অর্থাৎ চেতনা প্রবাহ রীতির উপন্যাসে চিন্তাভাবনাগুলি
প্রাক-বাচনিক স্তরের যুক্তি পারম্পর্য, বাক্যগত অন্বয়, শব্দের ব্যাকরণসম্মত ও প্রথাগত বিন্যাস ইত্যাদি গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত।
‘চেতনাপ্রবাহ’ বা
‘Stream of
consciousness' শব্দবন্ধটি মনস্তত্ত্ব থেকে আহৃত। প্রখ্যাত দার্শনিক
উইনিয়াম জেমস্ তার 'Principles
of Psychology' তে অর্ধচেতন স্তরের নানা ভাবনা-স্মৃতি অনুভব সহ মানব মনের
নিরন্তর প্রবাহকে নদীর প্রবাহমান জলধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন- “Consciousness
flow-let our call it stream of thought of consciousness, or of subjective
life.” ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এই ভাবনারই সমান্তরালে দেখা গেল
আর এক দার্শনিক বেগসঁর elanvital-এ, উভয় দার্শনিক
মানবমনের অন্তর্নিহিত চেতনার রহস্যটিকে ধরতে চেয়েছিলেন।
বৈশিষ্ট্যঃ -
1.
বহির্জগৎ নয়, অন্তর্জগতের টানা পোড়েনেই এ জাতীয় উপন্যাসের মনোনিবেশ ও প্রকাশের বিষয়।
2.
এ জাতীয় উপন্যাসে কোনও
আকর্ষণীয় গল্প / কাহিনী, একটি সুসংবদ্ধ প্লট থাকে না। কি ঘটছে তা দেখানো নয়, কেন এবং কিজন্য ঘটছে বা চরিত্রের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখানোই এর মূল
উদ্দেশ্য। কেবল সময়ানুক্রমিকভাবে একটি সুষম কাহিনী বিন্যাসে বিভিন্ন চরিত্রের
অন্তর্লীন আবেগ অনুভূতি এখানে ব্যক্ত করা হয় না।
3.
মানব মনের বহুবিচিত্র ও
অসংখ্য চিন্তা ও অনুভব, চরিত্রের যে অন্তলোক লোকচক্ষুর অন্তরালে তাকে গোচরীভূত করতে
লেখক গ্রহণ করেন—অন্তরস্থ স্বগতোক্তি বা Interior monolague'-এর কৌশল।
4.
মূলতঃ প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষ অন্তর্ভাষণ,
সর্বজ্ঞ বা সর্বদর্শী বিবরণ, এবং স্বগতোক্তির
মাধ্যমে ঔপন্যাসিক চেতনার প্রবাহটিকে দেখাবার চেষ্টা করেন।
5.
চেতনাপ্রবাহ মূলক
উপন্যাসে সময়ানুক্রমিক বিন্যাস (Chronological order) থাকেনা। এক স্তর থেকে
অন্যস্তরে চেতনা যেমন ছুটে চলে, তেমনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব এলোমেলোভাবে মিলে মিশে যায় চেতনা প্রবাহমূলক
উপন্যাসে।
6.
এই শ্রেণীর উপন্যাসে, ঔপন্যাসিক চরিত্রের অন্তর্মুখী বিশ্লেষণ দেখাতে পারেন, অতিক্রম করতে পারেন স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতার অন্তরালে। কখনো এগিয়ে, কখনো পেছিয়ে চেতনাপ্রবাহকে দিতে পারেন অনায়াস গতি।
7.
চেতনা প্রবাহরীতির
উপন্যাসে পাওয়া যায় এক অসম্ভব কল্পনামণ্ডিত, ছন্দোময় গদ্য, তাতে থাকে এক স্বয়ংক্রিয়তা ও আপাত অসংলগ্নতা; অনেক সময়ই ছেদ
বা যতি চিহ্ন বর্জন করে লেখক অনর্গল চেতনাপ্রবাহকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধরার চেষ্টা
করে থাকেন।
8.
আসলে চৈতন্যপ্রবাহ রীতির
পূর্বাভাস ছিল অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ উপন্যাসকার লরেন্স স্টার্নের ‘Tristram shandy
(1760-67) তে উপন্যাসের প্রচলিত কাঠামো ভেঙে আঙ্গিক ও ভাষার স্বীকৃত
রাজপথ পরিত্যাগ করে স্টার্ন মানব মনের গূঢ় জটিলতাকে ধরতে চেয়েছিলেন এক আপাত
অসংলগ্ন দুরধিগম্য কৌশলে। Tritram Shandy-র কোথাও কোথাও তাই সাদা
কিংবা কালো কিংবা তারকা চিহ্নিত পাতা মানবমনের অপার রহস্যভেদের বিচিত্র ফলশ্রুতি
রূপে পরিগণিত।
দৃষ্টান্ত : ইংরেজিতে চেতনাপ্রবাহ রীতির প্রথম সচেতন শিল্পী হেনরি জেম্স তাঁর
উপন্যাসে চরিত্রের অন্তর্লোককে উন্মোচন করেন, বিশ শতকের
দ্বিতীয় দশকে দেখা গেল অতীত স্মৃতি চারণা মূলক উপন্যাস রচনার প্রবণতা। ১৯১৩তে
প্রকাশ পেল মার্সেল প্রস্ত এর 'Remembrance of Things past (৬য় খণ্ড), ১৯১৫য় বের হল ডরোথি রিচার্ডসনের ‘pilgrimage' উপন্যাসের প্রথম খণ্ড ‘পয়েন্টেড রুফস'। এই উপন্যাস
আলোচনা সূত্রে সিনক্লেয়ার ‘চেতনাপ্রবাহ পদ্ধতি' কথাটা প্রথম
উল্লেখ করেন। ১৯২৬তে প্রকাশিত হল জেমস্ জয়েসের ‘এ পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট
অ্যাজ দ্য ইয়ং ম্যান’ মূলতঃ ভার্জিনিয়া উল্ফ ও জেমস জয়েস উপন্যাসে চেতনা প্রবাহ
রীতির মধ্য দিয়ে চরিত্রগুলিকে নিজেদের মুখোমুখি উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, রবীন্দ্রনাথের
‘চোখের বালি’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে বাইরে’, বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অন্তঃশীলা’, গোপাল হালদারের ‘একদা’, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘সৃষ্টি’, সতীনাথ ভাদুড়ীর
‘জাগরী’, ‘সংকট’, 'অচিনবাগিনী', সমরেশ বসুর 'বিবর', বিমল করের ‘অপরাহ্ন’, ‘অসময়' ইত্যাদি এই চেতনা প্রবাহধর্মী উপন্যাসের তাৎপর্যপূর্ণ
উদাহরণ। মনে রাখতে হবে, চেতনাপ্রবাহমূলক উপন্যাস মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাসের উন্নততর
রূপ।