ছোটগল্প কাকে বলে ? ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য কী ? ছোটগল্পের শ্রেণিবিভাগ
ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে এক অত্যাশ্চর্য সাহিত্যরূপ হিসেবে উদ্ভব ঘটে ছোট গল্পের । ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলা ছোট গল্পের উদ্ভব ঘটে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা
ছোটগল্পের ভগীরথ । তিনি প্রথম সার্থক ও প্রধান শিল্পী । কিন্তু তাঁর পূর্বে যে এই ধরণের রচনা
ছিল না ,তা নয় । পূর্ণচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারী দেবী, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত- -
প্রমুখ লেখক গল্পরচনায় পটভূমি প্রস্তুত করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭) নামক অনুবাদ
গ্রন্থটির ঘটনা উপস্থাপনায় গল্পরসের পরিচয় পাওয়া যায়।
ছোট গল্পের উদ্ভব ও বিকাশ :-
সৃজনী গদ্যসাহিত্যের জনপ্রিয় শিল্পরূপ ছোটোগল্প । ছোটোগল্পকে বলা হয় ‘Peculiar
product of the nineteenth century.’ । আধুনিক ছোটোগল্পের জনক অ্যাডগার অ্যালেন পো । আধুনিক ছোটো গল্পের বীজ
নিহিত ছিল নীতিগল্প তথা ফেব্ল্ , উপকথা বা
রূপকথার মধ্যে । বাংলা ছোট গল্পের উদ্ভব ও বিকাশ এবং সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অতুলনীয়। কেননা, ছোট গল্পের উদ্ভব স্বরূপ এটি যে একটি স্বতন্ত্র সাহিতরূপ (Literary form) এই ধারণাটি
রবীন্দ্রনাথের গল্পেই প্রথম ধরা পড়ে। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের 'ভিখারিণী' গল্পটি 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
মাত্র ষোল বছর বয়সে রচিত এই গল্পে ছোটগল্পের বিষয়বস্তু, রূপ ও রীতির সমস্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
ছোট গল্পের সংজ্ঞা -
1.
ছোটোগল্প সম্পর্কে আলোচনা
করতে গিয়ে অ্যাডগার অ্যালেন পো বলেছেন –
‘… a brief prose narrative requiring from half an hour to one or two hours in its perusal .’
2.
Hudson বলেছেন -
‘A short story is a story that can be easily read at a single siting.’
3.
ছোট গল্পের সংজ্ঞা
নির্দেশ করতে গিয়ে সমালোচক উইলিয়াম হেনরি হাডসন তাঁর ‘An introduction to the Study of Literature' গ্রন্থে বলেছেন -
“A Short story must contain one and only to its logical
conclusion with absolute singleness of Method.”
4.
এম. এই আব্রামস্ ছোট
গল্প কি এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন -
“A Short story is a brief work of prose fiction, and most
of the terms for analyzing the component, the types, and the narrative
techniques of the novel are applicable to the short story as well.”
5.
এইচ. জি. ওয়েলস ছোট
গল্প কাকে বলে তা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন -
“A short story is, or should be, a simple thing, it aims
at producing a single vivid effect; it has to seize the attention at the on
set, and never relaring, gather it together more and more until the climax is
reached.”
6. ব্র্যানডার ম্যাথুজ বলেছেন -
‘a short story deals with a single character , a single
event , a single emotion or the series of emotion called forth by a single
situation .’
7.
প্রথম চৌধুরী বলেছেন,
"ছোটগল্পকে প্রথমত ছোট, দ্বিতীয়ত গল্প হতে হবে। ছোটগল্পের হীরক কাঠিন্যের মধ্যে
থাকবে জীবনের কোন বিশিষ্ট দিক ও খণ্ডাংশ।"
8.
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
বলেছেন,
" গীতিকবিতা ও ছোটগল্প মেজাজের দিক
থেকে যেন যমজ ভাই। "
তবে ছোট গল্প কাকে বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'সোনারতরী' কাব্যগ্রন্থের 'বর্ষাযাপন' কবিতায় ছোটগল্পে
লক্ষ্মণসহ সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন -
ছোট প্রাণ ছোট কথা ছোট ছোট দুঃখব্যাথা
নিতান্তই সহজসরল।
সহস্র বিস্মৃতি রাশি
প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রুজল
নাহি বর্ণনার ছ’টা
ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে আতৃপ্তি হবে। সাঙ্গ করি মনে
হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাংশের ব্যাখ্যা দিয়েছেন
এইভাবে— “খাঁটি ছোটোগল্পের এই হল সহজ সুন্দর কাব্যিক ব্যাখ্যা। ‘ছোটো
প্ৰাণ, ছোটো ব্যথাই’ তার উপজীব্য। কিন্তু গোষ্পদে যেমন আকাশের ছায়া পড়ে তেমনি একটুখানি ক্ষুদ্র
চিত্রপটের মধ্যেই বিশালব্যাপ্ত মহাজীবনের ছায়া পড়বে। তত্ত্ব থাকবে, কিন্তু তাত্ত্বিকতা বড়ো হয়ে উঠবে না।—ফুলের গায়ে গন্ধের মতই তা অবিচ্ছিন্ন হয়ে বিরাজ করবে। কাহিনির ধূপ নিভে যাবে, কিন্তু তার ভাবের সৌরভটি মোহ বিস্তার করতে থাকবে ধীরে ধীরে।
অতএব লেখকের কলম যেখানে থেমে দাঁড়াবে, সেইখান থেকেই পাঠকের মনে গল্পটি সঞ্চারিত হয়ে চলবে।”
নারায়ণ
গঙ্গোপাধ্যায় ছোটোগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন -
'ছোটগল্প হচ্ছে প্রতীতি ( impression) জাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যকাহিনী যার একতম বক্তব্য কোনো ঘটনা বা কোনো পরিবেশ বা
কোনো মানসিকতাকে অবলম্বন করে ঐক্য সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে। '
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎকৃষ্ট ছোটগল্পের প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য
সম্পর্কে নির্দেশ করেছেন -
সংক্ষিপ্ত : ছোটগল্প সংক্ষিপ্ত, কারণ তা একটিমাত্র এপিসোড বা অভিজ্ঞতার শিল্পরূপ। এই
সংক্ষিপ্ততার জন্যেই ছোটগল্পের ভাষা বিবরণধর্মী নয়, সংকেতধর্মী।
সুডোল : ছড়ানো এলায়িত শিথিল - গ্রথিত নয়। ' এলোমেলো ডালপালার
পুনরাবৃত্তি ' নয়। থাকবে শিল্পরূপের
নিখুঁত ঐক্য, থাকবে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
নিটোল : সমস্ত অবান্তর অংশ বর্জন করে, অত্যাবশ্যকের সংরক্ষণ ও পরিস্ফুরণে ফুটে ওঠে ছোটগল্প, তার মধ্য দিয়েই সার্থক
হয়ে ওঠে জগৎ জীবন সম্পর্কে লেখকের ' প্রতীতির সমগ্রতা' বা ' Unity of impression ' ।
অনিবার্য : ছোটগল্পের ঐ প্রতীতিকে কেবল প্রধান নয়, একতম ও একৈকমুখী হতে হয়, পূর্বনির্ধারিত হতে হয়। গল্পের প্রথম বাক্য থেকেই গল্পের
পরিণতির আভাস মিলবে। এর মূলে গল্পলেখকের প্রজ্ঞা দৃষ্টি - যার আলোয় গল্পের
পরিসমাপ্তি প্রতিভাত।
উপসংহারের অপ্রত্যাশিত চমক : 'যা মার লাগায় মর্মে, লঘু লম্ফে।' ছোটগল্পের উপসংহারের অদ্ভূত
ক্ষিপ্রতা, চমক, মোচড় - যাকে বলা হয় ' চাবুক মারা সমাপ্তি '।
দৈবলব্ধ : ছোটগল্প হবে অনন্য, নিজস্ব রূপ লক্ষণে বিশিষ্ট। তা 'বৃত্তান্ত' নয় 'আখ্যায়িকা' নয় 'উপাদান' নয় সংক্ষেপিত উপন্যাস
নয়। তা স্বতন্ত্র, তা আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ, তা যেন দৈবলব্ধ ধন।
ছোটোগল্প সম্পর্কে কুন্তল চট্টোপাধ্যায় বলেছেন -
“তার সংক্ষিপ্ত পরিসরে ছোটোগল্প একটি বিদ্যুৎ চমকের মতো জগৎ ও জীবনের খানিকটা অংশ
উদ্ঘাটিত কর দেয় । ছোটোগল্পের শুরু যেমন চকিত , তাঁর শেষও তেমন অজ্ঞাত , অনুমানের আকাশে প্রলম্বিত। আর এই স্বল্পায়তন খণ্ডচিত্রের উদ্ভাসের মধ্যেই
খুঁজে নিতে হয সম্পূর্ণতা ; সে যেমন ঘটনার, তেমনই চরিত্রের এবং এ দুটোকে জড়িয়ে কোন একটি বক্তব্য বা প্রতিপাদ্য বিষয়ের। ছোটগল্পের জন্ম জীবনের ভগ্নাংশ থেকে ; ঘটনার আকস্মিকতায় তার শুরু, ছিন্ন-ভিন্ন জীবনসামগ্রীর স্বল্পতম ও স্বতঃস্ফূর্ত বয়নে এক
আশ্চর্য গতিময় তার রূপায়ণ। ছোটগল্প জীবনের এক
প্রতীকী প্রকাশ; ; খণ্ডজীবনের তুঙ্গ ঘনীভবন; বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের এক অসামান্য অভিজ্ঞতা।
সমাজজীবনের বিশাল ও বিস্তৃত প্রেক্ষিতে মানুষের বহুমুখী ও পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমরা পাই উপন্যাসে। অন্যদিকে ছোটগল্প 'ইম্প্রেশন-সঞ্জাত'; সময়ের ব্যাপ্তি, চরিত্রের ব্যাপ্তি, আবেগ-প্রবাহের ব্যাপ্তি, কিংবা বিচিত্রমুখী
জৈবনিক চঞ্চলতা ও তার গহনতা ছোটগল্পের প্রকৃতি ও প্রকরণের বিরোধী। উপন্যাসের বৃহৎ ও পূর্ণদৈর্ঘ্যের ক্যানভাসে মানবজীবন
পরিস্ফুট হয় বিস্তারের সাহায্যে ; অন্যদিকে ছোটগল্প জীবনকে আভাসিত করে রেখায় ও সংকেতে, প্রতীকী দ্যোতনায়, অপ্রত্যাশিত আশ্চর্য
ঝলকে যা শেষ পর্যন্ত গল্পের ক্ষেত্রভূমি ছাড়িয়ে যায় আনন্দ- বিস্ময়-সৌন্দর্যের এক অনন্তভূবনে ।”
সবমিলিয়ে আমরা বলতে পারি - যা
আয়তনের দিক থেকে ছোট, অনুভূতির দিক থেকে বিচিত্র্যমুখী, ভাবের দিকে থেকে সম্পূর্ণ / পূর্ণাঙ্গ গদ্যে লিখিত কাহিনীকে
আমরা ছোটগল্প বলতে পারি।
ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য :-
এই বৈশিষ্ট্য গুলো নিয়ে নীচে আলোচনা করা হলো -
1.
ছোটগল্প তাকেই বলা যায়
যা একেবারে বসে পড়া শেষ করে ফেলা যাবে। অর্থাৎ এর আয়তন হবে ছোট। অবশ্য এই একবারে
বসে পড়াটা এক পৃষ্ঠারও হতে পারে আবার একশো পৃষ্ঠারও হতে পারে।
2.
ছোটগল্প আবর্তিত হয়
একটিমাত্র ভাবকে কেন্দ্র করে।
3.
ছোটগল্প পূর্ণাঙ্গ
জীবনকে ধরে না ধরে জীবনের খণ্ডাংশকে। এইজন্য ছোটগল্পে কোনো শাখাকাহিনী বা উপকাহিনী
স্থান পায় না।
4.
ছোটগল্পের চরিত্র সংখ্যা
একদম প্রয়োজনমতো হয়ে থাকে। কখন কখনও গল্পে মাত্র দুটি, এমনকী একটি মাত্র চরিত্র নিয়েও গড়ে ওঠে। চরিত্রের
পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ও বিস্তার এখানে ঘটে না।
5.
ছোটগল্প ঋজু টানটান -
তীব্র গতিবেগ সম্পন্ন। যেন জ্যামুক্ত তীরের শুরু থেকে শেষ অবধি ছুটে চলে।
6.
ছোটগল্পের সমাপ্তিতে
নাটকীয় হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'সাঙ্গ করি মনে হবে। শেষ হয়েও হইল না শেষ।'
7.
ছোটগদ্ধের ভাষা
ইঙ্গিতময়। প্রতীক সংকেতের মাধ্যমে গভীর ব্যাঞ্জনার প্রকাশ ঘটে। শব্দচয়ন ও অলংকার
প্রয়োগ ছোটগল্প বিশেষ তাৎপর্যবাহী হয়ে ওঠে।
8.
ছোটগল্পে বিষয়
বৈচিত্র্যের প্রাধান্য দেখা যায়। যেকোনো বিষয় নিয়েই ছোটগল্প গড়ে উড়তে পারে।
ছোটগল্পের শ্রেণিবিভাগ :-
ছোটগল্প জীবনের যে কোন বিষয় অবলম্বনেই রচিত হতে পারে। বিচিত্র বর্ণে ও পথে
জীবনের প্রকাশ ঘটে বলে ছোটগল্পও হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যধর্মী। তাই কোন সুনির্দিষ্ট
শ্রেণিতে ছোটগল্পকে বিন্যস্ত করা যায় না। তবু ছোটগল্পকে মোটামুটি কয়েকটি
শ্রেণিতে বিভক্ত করা চলে।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় মোট বারোটি উপবিভাগ করেছেন দার্শনিক, সমাজ-সমস্যামূলক, নারী- পুরুষের মধ্যগত
সম্পর্ক ও প্রশ্নাত্মক, মনস্তাত্ত্বিক, রোমান্টিক, চরিত্রাত্মক, রূপক, ব্যঙ্গ মূলক, কাব্যধর্মী, আদর্শাত্মক ও রাজনৈতিক, অতিলৌকিক এবং বিচিত্র। 'সাহিত্য-সন্দর্শন' গ্রন্থে শ্রীশচন্দ্র দাশ
নিম্নলিখিত বিভাগগুলির কথা বলেছেন—
1. প্ৰেমবিষয়ক : প্রেমই এই গল্পে প্রধান অবলম্বন । নরনারীর সম্পর্কের বিচিত্র গতি , আনন্দ-বেদনা , দ্বিধা – সংশয়
এই ধরণের গল্পে প্রতিফলিত হয় । যথা তুর্গেনেভের The District Doctor, রবীন্দ্রনাথের ‘শেষরাত্রি', প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ভস্মশেষ' , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্পিল প্রভৃতি।
2. প্রকৃতি ও মানুষ : এই শ্রেণীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা
হয়েছে—“এই শ্রেণীর গল্পে প্রকৃতির পটভূমিকায় চরিত্রাঙ্কন করা হয় এবং প্রকৃতি
মানুষের সুখ-দুঃখের পশ্চাৎ-পট রূপে ব্যবহৃত হয়।” এই সংজ্ঞা থেকে মনে হয় Wordsworth লুসি গ্রে-র যে গল্প
কবিতায় শুনিয়েছেন সেরকম গল্পই এই শ্রেণীতে পড়তে পারে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের 'অতিথি', 'শুভা', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুইমাচা , মৌরীফুল
মনোজ বসুর ‘বনমর্মর' এই শ্রেণীর গল্পের উদাহরণ বলা যায়।
3. অতি প্ৰাকৃত: ভৌতিক বা অলৌকিক জগতের অবতারণা না
করে কেবলমাত্র অতিপ্রাকৃতের রহস্যে পাঠককে অভিভূত করে রাখাই প্রকৃত অতিপ্রাকৃত
গল্পের লক্ষ্য। গোগোলের 'ক্রিসমাস ইভ', এডগার অ্যালান পো-র ‘ব্লাক ক্যাট', বা 'দি ফল অব দি হাউস অব
আশার', রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত
পাষাণ' বা 'মণিহারা', সুবোধ ঘোষের ‘ন তস্থৌ', শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মর্কট’, বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাসি', সত্যজিৎ রায়ের 'নীল আতঙ্ক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
4. হাস্যরসাত্মক: নামেই এই শ্রেণীর পরিচয়, তবে হাসির উদ্ভব ঘটতে
পারে বিভিন্ন ভাবে—সামাজিক অসংগতি থেকে, চরিত্রগত অতিরঞ্জন থেকে, অথবা ঘটনাগত সজ্জা থেকে। উডহাউসের 'দি কাস্টডি অব অব দি পাম্পকিন', রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তির উপায়’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘বলবান
জামাতা’ বা ‘মাস্টারমশাই', ত্রৈলোক্যনাথ
মুখোপাধ্যায়ের 'ডমরুধর- চরিত’, পরশুরামের ‘ভূশণ্ডীর মাঠ, বা ‘গড্ডলিকা’, শিবরাম চক্রবর্তীর ‘শুঁড়ওয়ালা
বাবা’ অথবা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘সোফা-কাম বেড’ এই জাতীয় গল্পের
উদাহরণ।
5. উদ্ভট: অসম্ভব বা অবাস্তব কাহিনী
অবলম্বনে এই শ্রেনীঢ় গোল্প ড়োচীট হোয় । ইংরেজিতে যাকে বলে Fantasy, বাংলায় তাকেই উদ্ভট গল্প বলা চলে। অসম্ভব কল্পনার মধ্যে কৌতুকই সাধারণত
প্রধান হয়ে ওঠে। এইচ.জি. ওয়েলস-এর ‘দি ইনভিজিব্ল্ ম্যান', পরশুরামের ‘গগনচটি, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ভগবতীর পলায়ন', সত্যজিৎ রায়ের 'অঙ্কস্যার ও গোলাপি বাবু’ প্রভৃতি গল্পের নাম করা
যায়।
6. সাঙ্কেতিক গল্প: সাধারণভাবে আপাতবর্ণিত বিষয় বা
ঘটনা যেখানে একটি রহস্যময় সঙ্কেতকে আশ্রয় করে থাকে সেখানে এই শ্রেণীর গল্পের
উদ্ভব ঘটে। রূপকধর্মী বা Allegorical গল্প এই শ্রেণীর
অন্তর্ভুক্ত নয়, symbolic বা সাঙ্কেতিক ব্যঞ্জনাই এসব গল্পের প্রাণ। উদাহরণ হিসাবে সামারসেট মমের ‘দি
রেন’, রবীন্দ্রনাথের ‘একটি
অসম্ভব গল্প', নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের
‘রাতের গাড়ি', বিমল করের 'বাঘ' প্রভৃতি গল্পের নাম করা যেতে
পারে।
7. ঐতিহাসিক : ইতিহাসের পটভূমিকায় কথাসাহিত্যিকগণ
উপন্যাস লেখার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী হন, তবে ছোটগল্পেও ঐতিহাসিক আখ্যানকে অবলম্বন করা হতে পারে। এই ধরনের গল্পের
দৃষ্টান্ত— রবীন্দ্রনাথের ‘দালিয়া’, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মৃৎপ্রদীপ’, বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রত্নতত্ত্ব' প্রভৃতি।
8. বিজ্ঞাননির্ভর। এই জাতীয় গল্পকে ইংরেজিতে বলে
সায়েন্স-ফিকশন। বিজ্ঞানের কোনো প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অবলম্বন করে সুস্থ কল্পনার
দ্বারা এরকম গল্প লেখা হয়। উদ্ভট গল্পেও মাঝে মাঝে বিজ্ঞান থাকে বটে, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি
কোনরকম আনুগত্য সেসব গল্পে থাকে না। এইচ. জি. ওয়েল্স ও জুলে ভার্নের গল্প এই
জাতীয় গল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ যুগের লেখকদের মধ্যে আইজ্যাক অ্যাসিমভ এবং আর্থার
সি ক্লার্কের নাম করা যেতে পারে। বাংলায় বিজ্ঞাননির্ভর গল্প খুব কম, যা আছে তার মধ্যে
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্প উল্লেখযোগ্য। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য শুধু
বিজ্ঞাননির্ভর গল্পই রচনা করেছেন।
9. গার্হস্থ্য: পারিবারিক বা গার্হস্থ্য জীবন
অবলম্বন করে লেখা গল্পকেও একটি স্বতন্ত্র শ্রেণীতে ফেলা যেতে পারে। চেকভ ও
রবীন্দ্রনাথের গল্পে এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে।
10. মনস্তাত্ত্বিক : পৃথক শ্রেণীতে মনস্তাত্ত্বিক
গল্পকে বিন্যস্ত করা শক্ত, কারণ মনস্তত্ত্ব নির্ভর না হলে ছোটগল্পের আকর্ষণ অনেক কমে যায়। তবু
মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা অত্যধিক প্রাধান্য পেলে তাকে আমরা এই শ্রেণীতে ফেলতে পারি, যেমন—রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি', ‘শাস্তি', শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ', নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'হাড়', বিমল মিত্রের 'লজ্জাহর', আবুল বাশারের ‘হবা' প্রভৃতি।
11. মনুষ্যেতর : মানুষ ভিন্ন অন্যান্য জীবজন্তু ,পশুপাখি নিয়ে রচিত গল্প হল মনুষ্যেতর গল্প । । এমনকি একটি গাড়ি নিয়ে লেখা সুবোধ ঘোষের 'অযান্ত্রিক' গল্পটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প হিসাবে স্বীকৃত। মনুষ্যেতর গল্পের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হল বালজাকের 'Passion in the desert', জন স্টেইনবেকের 'The snake', প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায়ের 'আদরিণী', তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কালাপাহাড়’, ‘নারী ও নাগিনী’, বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বুধির বাড়ী ফেরা' প্রভৃতি ।
12. বাস্তবনিষ্ঠ গল্প: ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বাস্তবনিষ্ঠতা । সাধারণভাবে ন্যাচারালিস্ট আন্দোলনে উদ্ভূত গল্পগুলিকে এই শ্রেণীতে ফেলা হয়।
বাংলা ছোটগল্পের মধ্যে শৈলজানন্দের 'কয়লা কুঠির গল্প’, জগদীশ গুপ্তের ‘রামের টাকা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’, সমরেশ বসুর ‘পাড়ি' প্রভৃতি এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
13. গোয়েন্দা গল্প: বিভিন্ন অসামাজিক , আইন বিরুদ্ধকাজ
ও তার অপরাধীকে খুঁজে বের করা এই শ্রেণির গল্পের প্রধান উপজীব্য । অপরাধ এবং অপরাধীকে ধরার ব্যাপারে পুলিশ বা গোয়েন্দার তৎপরতা যে সব গল্পের
মুখ্য অবলম্বন তাদের বলা যেতে পারে গোয়েন্দা গল্প। ইংরেজিতে এই ধরনের গল্পে দক্ষতা
দেখিয়েছেন এডগার অ্যালান পো, আর্থার কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, চেস্টারটন। বাংলায় এই শ্রেণীর গল্পে দক্ষতা দেখতে পাই পাঁচকড়ি দে, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, শরদিন্দু
বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় প্রভৃতি সাহিত্যিক ।
14. বিদেশী পটভূমিকাযুক্ত গল্প - বাংলা তথা ভারতের বাইরের কিছু অনবদ্য বাংলা ছোটগল্প রচিত
হয়েছে, তাদের আমরা এই শ্রেণীতে
ফেলতে পারি। এই সব গল্পের মধ্যে প্রধান অবিনাশচন্দ্র বসুর 'বম্বের মোহ’, রাখাল সেনের 'সহযাত্রী', প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুলের মুল্য', 'ভিখারী সাহেব', মণীন্দ্রলাল বসুর 'হোটেলওয়ালা' প্রভৃতি।
ছোটগল্পের ভিন্নতর বিভাগ
বিষয়ভিত্তিক এই বিভাগে ছোটগল্পের প্রকৃতি প্রায় উপেক্ষিতই থাকে। এর
প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে পাশ্চাত্য সমালোচকগণ তিন ধরনের শ্রেণীবিভাগের পক্ষপাতী
(ক) Story of Incident বা ঘটনামুখ্য গল্প।
(1) Story of Character বা চরিত্রমুখ্য গল্প।
(গ) Story of Impression বা প্রতীতিমুখ্য গল্প।