অপাদান কারক
একটি উদ্দেশ্য এবং একটি বিধেয় নিয়ে বাক্য গঠিত হয় । উদ্দেশ্য বলতে সাধারণত আমরা কর্তাকে বুঝি । বিধেয় বলতে আমরা সমাপিকা ক্রিয়াকে বুঝি । এছাড়াও একাধিক পদ বিধেয় ক্রয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাক্যকে দীর্ঘায়িত করে । সেই পদগুলি কোনো না কোনো সম্পর্কে ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্পর্কিত । সেই সম্পর্ককে কারক বলে । কারক ছয় প্রকার – কর্তৃকারক , কর্মকারক , করণ কারক , অপাদান কারক , অধিকরণ কারক , নিমিত্ত কারক ।
এছাড়াও আরও কিছু কিছু পদ বাক্যের মধ্যে থাকে , কিন্তু তাদের সাথে সমাপিকা ক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক থাকে না । তাদের সম্পর্ক থাকে বাক্যের অন্তর্গত অন্য কোনো নামপদের সাথে । ব্যাকরণে সেই সম্পর্ককে ‘অকারক’ বলে । অকারক দুই প্রকার – (ক) সম্বন্ধ পদ ও (খ) সম্বোধন পদ ।
আজ আমরা অপাদান কারক সম্পর্কে আলোচনা করবো -
[“ক্রিয়ার
সহিত অন্বয়ের অভাবে অপাদান কারক অস্তিত্বহীন।” – রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ]
1.
পরমা নৌকা থেকে
ঝাঁপ দিল।
2.
তিলে তেল হয় ।
3.
সকাল থেকে বৃষটি হচ্ছে ।
4.
টাকাটা পথে কুড়িয়ে পেলাম ।
5.
বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে
মোর প্রার্থনা।
উপরের উদাহরণগুলিকে ‘কী থেকে’ বা
‘কোথা থেকে’ বা ‘কখন থেকে’ দিয়ে প্রশ্ন
করলে যথাক্রমে ‘নৌকা থেকে’ , ‘তিল থেকে’ , ‘সকাল থেকে’ , ‘পথ থেকে’ , ‘বিপদ থেকে’
উত্তর আসবে ।
সংস্কৃত ব্যাকরণে বলা হয়েছে ‘ধ্রূবমপায়ে অপাদানম্’ । যা থেকে কোনো কিছু
‘অপায় বা বিচ্ছেদ’ ঘটে অর্থাৎ ভীত, পতিত, চলিত,
বিচ্যুত, অপসৃত, স্খলিত,
রক্ষিত, বিরত, গৃহীত ইত্যাদি হয়, তাকে বলা হয়
অপাদান কারক।
ক্রিয়াকে ‘কোথা থেকে’ , ‘কখন থেকে’, ‘কী থেকে’, ইত্যাদি দিয়ে প্রশ্ন করলে অপাদান কারক পাওয়া যায়। অপাদান কারকে ‘হইতে’ , ‘থেকে’ , ‘চেয়ে’ , ‘অপেক্ষা’ ইতাদি অনুসর্গের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় ।
অপাদান কারকের শ্রেণিবিভাগ :
(১) স্থানবাচক বা আধারবাচক অপাদান : বাক্যে কোনো স্থান বা আধার থেকে কোনো
কিছুর বিশ্লেষ বা বিচ্যুতি বোঝালে তাকে স্থানবাচক বা আধারবাচক অপাদান বলে। সমাপিকা ক্রিয়াকে ‘কোথা থেকে’ দিয়ে প্রশ্ন করলে স্থানবাচক
অপাদান পাওয়া যায় ।
[ আধার অধিকরণ ও স্থানবাচক অপাদান প্রায় একই রকম । কাজেই খুব সাবধানে প্রশ্ন করতে হবে । যদি ‘কোথায়’ দিয়ে প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়া যায় তাহলে তাকে অতি অবশ্যই ‘কোথা থেকে’ দিয়ে প্রশ্ন করতে হবে । যদি দু-বারই একই উত্তর আসে তাহলে অধিকরণ কারক হবে না , অপাদান কারক হবে । ]
1.
সুনীল কলকাতা থেকে
এসেছে।
2.
গাছ থেকে ফল পড়ে ।
3.
পথে টাকাটা কুড়িয়ে পেলাম । (পথ থেকে )
4.
‘মুছিলা সিন্দুর বিন্দু সুন্দর
ললাটে ।’ (ললাট হইতে )
5. কথাটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম ।
(২) অবস্থানবাচক অপাদান : যে অপাদান কারকের মাধ্যমে ক্রিয়া সম্পাদনের অবস্থান বোঝানো হয় , অর্থাৎ কোনো অবস্থান থেকে কোনো ক্রিয়া বা কাজ সম্পন্ন হলে তাকে অবস্থানবাচক অপাদান বলে। অবস্থানবাচক অপাদানে কর্তার স্থানচ্যুতি হয় না , কর্মের বিচ্যুতি হয় ।
1.
তীর থেকে সবাই সাঁতার
কাটা দেখছে। (কর্তা ‘সবাই’ তীরেই আছে)
2.
সে ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে
। (কর্তা ‘সে’ ছাদেই আছে।)
3.
জানালা থেকে পাহাড় দেখা যায় । (কর্তা জানালার কাছেই আছে )
4.
বারান্দা থেকে নদী দেখা যায় ।
5. দেবতারা স্বর্গ থেকে পুষ্প বৃষ্টি করলেন । (দেবতারা স্বর্গেই আছেন )
(৩) কালবাচক অপাদান: যে অপাদান কাল বা সময় নির্দেশ করে তাকে কালবাচক অপাদান বলে।
সমাপিকা ক্রিয়াকে ‘কখন
থেকে’ দিয়ে প্রশ্ন করলে কালবাচক অপাদানকারক পাওয়া যায় ।
1.
‘সকাল থেকে বাদল হল ফুরিয়া এল বেলা।’
2.
শিশুকাল থেকেই সে ডানপিটে ।
3.
সন্ধ্যা থেকে আরতি শুরু হয় ।
4.
‘সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা।’
5. ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে , কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি’
(৪) দূরত্ববাচক অপাদান
– যে
অপাদানে কোণো স্থান থেকে অন্য আর একটি স্থানের দূরত্ব নির্দেশ করা হয় তাকে দূরত্ববাচক
অপাদান বলা হয় ।
দূরত্ববাচক অপাদানে দুটি
স্থানের দূরত্ব বোঝানো হয় , হইতে,থেকে,চেয়ে,অপেক্ষা ইত্যাদি অনুসর্গের ব্যবহার
থাকে । তবে কখনো কখনো একটি স্থানের উল্লেখ না থাকতেও পারে।
1.
‘বুন্দির কেল্লা চিতোর থেকে যোজন তিনেক
দূর।’
2.
দিল্লী হইতে কোলকাতা একদিনের রাস্তা
।
3.
এখান থেকে বাড়ি বেশি দূর নয় ।
4.
এখান থেকে পাঁচ কিমির বেশি হবে
না ।
5. বাড়ি থেকে কতদূর গেল কে জানে ?
(৫) বিকতিবাচক অপাদান: যে অপাদানে বস্তুর স্বাভাবিক অবস্থার বিকৃতি
সূচিত হয় তাকে বিকৃতিবাচক অপাদান বলে ।
এই অপাদানের ক্ষেত্রে মূলের আকার পরিবর্তিত হয়ে অন্য জিনিসে রূপান্তরিত হয়।
1.
দুধ থেকে ছানা হলো।
2.
টাকায় সবই হয় ।
3.
তিলে তেল হয় ।
4. ধানে চাল হয় ।
(৬) তারতম্যবাচক অপাদান : একাধিক বস্তু, ব্যক্তি বা ভাবের মধ্যে তুলনা করা বোঝালে তারতম্যবাচক অপাদান হয়।
‘চেয়ে’,
‘অপেক্ষা’, ‘থেকে’ ইত্যাদি
অনুসর্গের ব্যবহার করা হয় ।
1.
সীমার থেকে নীতু ভালো নাচে।
2.
রাম অপেক্ষা শ্যাম বুদ্ধিমান ।
3.
‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন।’
4.
সোনার চেয়ে রূপা সস্তা ।
5. একতলা অপেক্ষা দোতলা বেশি নিরাপদ।
(৭) অসমাপিকা ক্রিয়াবাচক অপাদান : অসমাপিকা ক্রিয়া অপাদান কারকের কাজ করলে তাকে অসমাপিকা ক্রিয়াবাচক অপাদান বলা হয়।
1.
বিপ্লবীরা মরতে ভয়
পায় না । (মরা থেকে)
2.
হঠাৎ তিনি বলতে বিরত
হলেন । ( বলা থেকে)
3.
বিপদ আছে জেনেও তিনি যেতে
ভয় পেলেন না । (যাওয়া থেকে)
4.
‘রামগড়ুরের ছানা হাসতে
তাদের মানা।’ (হাসা থেকে)
অকারক ও শ্রেণিবিভাগ