কর্মকারক ও তার শ্রেণিবিভাগ
একটি উদ্দেশ্য এবং একটি বিধেয় নিয়ে বাক্য গঠিত হয় । উদ্দেশ্য বলতে সাধারণত আমরা কর্তাকে বুঝি । বিধেয় বলতে আমরা সমাপিকা ক্রিয়াকে বুঝি । এছাড়াও একাধিক পদ বিধেয় ক্রয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাক্যকে দীর্ঘায়িত করে । সেই পদগুলি কোনো না কোনো সম্পর্কে ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্পর্কিত । সেই সম্পর্ককে কারক বলে । কারক ছয় প্রকার – কর্তৃকারক , কর্মকারক , করণ কারক , অপাদান কারক , অধিকরণ কারক , নিমিত্ত কারক ।
এছাড়াও আরও কিছু কিছু পদ বাক্যের মধ্যে থাকে , কিন্তু তাদের সাথে সমাপিকা ক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক থাকে না । তাদের সম্পর্ক থাকে বাক্যের অন্তর্গত অন্য কোনো নামপদের সাথে । ব্যাকরণে সেই সম্পর্ককে ‘অকারক’ বলে । অকারক দুই প্রকার – (ক) সম্বন্ধ পদ ও (খ) সম্বোধন পদ ।
আজ আমরা কর্মকারক সম্পর্কে আলোচনা করবো -
কর্তা যা করে বা যাকে আশ্রয় করে ক্রিয়া সম্পাদন করে তাকে কর্মকারক বলে।
বাক্যের অন্তর্ভুক্ত ক্রিয়া পদকে ‘কি' বা 'কাকে' দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া
যায়, তাই কর্মকারক।
যেমন –
1.
জেলেরা মাছ ধরে। এখানে ‘জেলেরা’ কৰ্তা, ‘ধরে’ ক্রিয়া। এই কাজটি
সম্পাদিত হচ্ছে। ‘মাছ’ কে কেন্দ্র করে, তাই ‘মাছ’ কর্মকারক।
2.
হরি ছবি আঁকে। এখানে
‘হরি’ কৰ্তা,
‘আঁকা’ ক্রিয়া। এই কাজটি সম্পাদিত হচ্ছে ‘ছবি’ কে কেন্দ্র
করে,
তাই ‘ছবি’ কর্মকারক।
কর্মকারকের শ্রেণিবিভাগ
(ক) মুখ্য কর্ম ও গৌণ কর্ম : কতকগুলি সকর্মিকা
ক্রিয়ার দুটি করে কর্ম থাকে, একটি প্রাণিবাচক, অন্যটি বস্তুবাচক। প্রাণিবাচক কর্মটিকে গৌণ কর্ম ও বস্তুবাচক কর্মটিকে মুখ্য
কর্ম বলে। সাধারণত মুখ্যকর্মে ‘শূন্য
বিভক্তি’ এবং গৌণ কর্মে ‘কে’ বিভক্তি যুক্ত হয় ।
যেমন-
1.
আমি তোমায় বই কিনতে একশো টাকা
দিলাম।
গৌণ কর্ম – তোমায় , মুখ্য কর্ম – বই
2.
তিনি আমাকে একটি কলম
উপহার দিয়েছেন।
এই বাক্যে ‘আমাকে’ গৌণ কর্ম এবং 'কলম' মুখ্য কর্ম। কারণ 'আমাকে' শব্দটির সঙ্গে ‘কে’ বিভক্তি যুক্ত হয়েছে।
3.
বাবা আমাকে জামা
কিনে দিয়েছেন।
এই বাক্যে ‘জামা' মুখ্য কর্ম এবং ‘আমাকে’ গৌণ কর্ম। কারণ ‘জামা' শব্দটির সাথে কোন বিভক্তি যুক্ত হয়নি।
(খ) উদ্দেশ্য কর্ম ও বিধেয় কর্ম : কিছু ক্রিয়ার কর্মের
পরিপুরক হিসাবে অন্য পদ ব্যবহার করতে হয়। এই পরিপুরক পদটিকে বিধেয় কর্ম, আর প্রধান কর্মটিকে উদ্দেশ্য কর্ম বলে। যেখানে উদ্দেশ্য কর্মটির অবস্থান
বাক্যের প্রথমে হয় আর তা বিভক্তিযুক্ত হয়, তার বিভক্তিহীন বিধেয় কর্মটি বাক্যে পরে বসে।
1.
“তোমারে (উদ্দেশ্য কর্ম) করিল
বিধি ভিক্ষুকের প্রতিনিধি (বিধেয় কৰ্ম)।”
2.
পরমহংসদেব টাকাকে
(উদ্দেশ্য কর্ম) মাটি (বিধেয় কর্ম), আর মাটিকে (উদ্দেশ্য কর্ম) টাকা (বিধেয় কর্ম) মনে করিতেন।
3.
“আমার কিবা দিবা কিবা
সন্ধ্যা, সন্ধ্যাকে বন্ধ্যা
করেছি।”
4.
অর্থকেই লোকে পরমার্থ
জ্ঞান করে।
5.
“দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।”
6.
“রাতি (উদ্দেশ্য কর্ম)
কৈনু দিবস (বিধেয় কর্ম), দিবস (উদ্দেশ্য কর্ম) কৈনু রাতি (বিধেয় কর্ম)।”
7.
রমেশকে রমেন মনে
করেছিলাম।
8.
তিনি আমাকে সত্যবাদী
বলেছেন।
9.
দুধকে মোরা দুগ্ধ বলি, হলুদকে বলি হরিদ্রা।
10.
তিনি দেশকে জননী ভাবতেন।
(গ) সমধাতুজ কর্ম : কোন কোন অকর্মক ক্রিয়ার
ক্ষেত্রে সেই ক্রিয়াজাত কোন শব্দকে কর্মরূপে ব্যবহার করে ক্রিয়া নিষ্পন্ন করতে
হয়
।
এরূপ কর্মকে সমধাতুজ কর্ম বলে।
এই ধরণের বাক্যে ক্রিয়া ও কর্মটি একই ধাতু থেকে
উৎপন্ন হয় বলে তাকে সমধাতুজ কর্ম বলে।
1.
সে বেশ এক ঘুম
ঘুমিয়েছে। (‘ঘুম্’ ধাতু)
2.
সে কি কান্নাই না কাঁদল।
(‘কাঁদ্’
ধাতু)
3.
অমন নাচ নাইবা নাচলে। (‘নাচ্’
ধাতু)
4.
আরও জোরে বাজনা বাজাও। (‘বাজ্’ ধাতু)
5. সারা রাত ধরে গান গাওয়া হলো। (‘গা’ ধাতু)
(ঘ) উহ্য কর্ম : বাক্যে সকর্মক ক্রিয়ার কর্ম উহ্য থাকলে সেই কর্মকে উহ্য
কর্ম বলে।
1.
আপনি এখনও খাননি (সকর্মক
খা ধাতুর কর্ম ভাত বা রুটি ঊহ্য)।
2.
“মনমাঝি তোর বইঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারি না।”
(বাইতে সকর্মিকা ক্রিয়ার কর্ম দাঁড় উহ্য)।
3.
ঘোড়াটা বছরদশেক টানছে
(কর্ম গাড়ি উহ্য)।
4.
শ্রীকান্ত গাইছেন। কী
গাইছেন তা উহ্য।
5. আমি পড়ছি। কী পড়া হচ্ছে তা উহ্য।
(ঙ) উপবাক্যীয় কর্ম : বাক্যের অকর্মক ক্রিয়ার কর্মরূপে যখন কোনো অপ্রধান উপবাক্য
ব্যবহৃত হয় তখন সেই উপবাক্যটিকে উপবাক্যীয় কর্ম বলে। জটিল বাক্যের অপ্রধান
উপাদান-বাক্য বিশেষ্যধর্মী হইলে সেটি প্রধান উপাদান-বাক্যের অন্তর্গত সকর্মিকা
ক্রিয়ার কর্ম হইতে পারে।
1.
“কে না জানে অম্বুবিম্ব
অম্বুমুখে সদ্যঃপাতী?”
2. সাধুতাই শ্রেষ্ঠ পন্থা জানিহ নিশ্চয়।
3.
“শুন ধনি, রাজকাজ দরিদ্র-পালন।”
4.
জন্মিলে মরিতে হবে জানিহ নিশ্চয়
5.
রাজা বুঝিলেন আয়োজনের
ত্রুটি নাই।
6.
তিনি কোথায় গেলেন কেউ জানে না ।
7.
সকলে জানে সূর্য
পূর্বদিকে উঠে ।
8.
গিয়ে শুনি ব্রহ্মপুত্রে
বন্যা এসেছে ।
9.
আমি বুঝলুম লেঠেলদের
কথা ঠিক।
10.
নিমাইবাবু কহিলেন ঐটি
বলতে পারবো না বাবা।
11.
রোদে বাইরের আকাশ পুড়ছে আমাদের অজানা নয়।
12.
আমার ইচ্ছা করে যে খুব
দূরদেশে চলে যাই।
13.
তুমি যে ওখানে ছিলে না তাহা আমি জানি।
14.
বোধ হয় সে আসবে না।
15. কেবল মনে পড়ে জল পড়ে পাতা নড়ে।
(চ) বাক্যাংশ কর্ম : প্রধান ক্রিয়ার কর্ম হিসাবে ক্রিয়া বিহীন বাক্যাংশ
ব্যবহৃত হলে তাকে বলে বাক্যাংশ কর্ম। সমাপিকা ক্রিয়াবিহীন পদসমষ্টি বিশেষ্যধর্মী
হইয়া একটি অখণ্ড ভাব প্রকাশ করিলে বাক্যটির প্রধান সকর্মিকা ক্রিয়ার কর্ম হইতে
পারে।
1.
আমতা আমতা করে কথা বলা পছন্দ করি না।
2.
কোকিলের মিষ্টি সুরে
কুহু কুহু ডাকা আমি বড়ো ভালোবাসি।
3.
এতো থেমে থেমে কাজ করতে আমার ভালো লাগে না।
4.
শেষ বেলার রক্ত রাঙা আকাশ আমি দেখেছি ।
5.
একের পর এক হেরে যাওয়া আমি আর মেনে নেব না।
6.
তোমার এভাবে ওকে এড়িয়ে যাওয়া
উচিত হয়নি ।
7. এভাবে তার উল্টোপাল্টা কথা বলা আর ভালো লাগে না ।
(ছ) অক্ষুণ্ণ কর্ম : কর্তৃবাচ্যের
দুটি কর্ম কর্মবাচ্যেও অপরিবর্তিত থাকিলে, সেই কর্মকে অক্ষুণ্ণ কর্ম বলা হয়।
1.
মহর্ষি শকুন্তলাকে
শাশ্বত নারীধর্মের কথাই বলিয়াছেন (কর্তৃবাচ্য : শকুন্তলাকে ও
কথা—দুইটি কর্ম)।
(মহর্ষির দ্বারা) শকুন্তলাকে শাশ্বত নারীধর্মের কথাই বলা হইয়াছে
(কর্মবাচ্য—দুইটি কর্মই অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে)।
2. নজরুল অগ্নিবীণা কাব্যটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছেন ।
নজরুলের অগ্নিবীণা কাব্যটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা হয়েছে ।
(জ) কর্মে বীপ্সা : ‘বীপ্সা’ শব্দের অর্থ বার
বার প্রয়োগ। অর্থাৎ বাক্যে কর্মপদটির একাধিকবার পুনরাবৃত্তি হলে তাকে আমরা বলবো
কর্মে বীপ্সা।
1.
“জনে জনে ডাকিয়াছি, করেছে বিমুখ।”
2.
কী কী চাও, বল।
3.
যা যা বলেছিলুম, করেছ?
4.
কাকে কাকে দেবে ঠিক কর ।
5.
সবই তো বলে বলে করালাম
।
6. ‘এখন আমি তোমার ঘরে বসে করব শুধু পড়া পড়া খেলা।’
(ঝ) অসমাপিকা ক্রিয়ারূপ কর্ম : অসমাপিকা ক্রিয়া ভাববিশেষ্যের অর্থে প্রযুক্ত হইলে মাঝে মাঝে কর্মভাব পায়।
1.
“মরিতে চাহি না
আমি সুন্দর ভুবনে।”
2.
বাঙালী কি হাসতে
ভুলেছে?
3.
আমরা বাঁচতে
চাই—বাঁচার মতো বাঁচা
4.
খোকা এখন হাঁটতে
শিখেছে।
5.
সে বেশি খেতে চায় না ।
6.
বলতে পারলে এমন কথা ।
7.
আমার বোধহয় যাওয়া হবে না ।
8.
সবাই ডাকলে তবেই যাব ।
9.
তাহলে আমি পথ খুলে দিতে রাজি আছি ।
10.
তাকে অনেকবার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ।
অকারক ও শ্রেণিবিভাগ